ওয়াজের ময়দানে বক্তাদের কিচ্ছা-কাহিনি : ইসলাম কী বলে?
ওয়াজ মানে হলো উপদেশ, নসিহত, বক্তৃতা। আরও সহজে বললে ওয়াজ হলো এমন কথামালা, যা অন্তরে আল্লাহভীতি সৃষ্টি করে, মানুষের হৃদয়কে নরম করে। আর কিচ্ছা বলা হয় গল্প, উপাখ্যান, কল্পকথা ইত্যাদিকে। নবিযুগ থেকে যে ওয়াজ-নসিহতের প্রচলন ছিল, তাতে থাকতো কুরআনের আয়াত, হাদিস, তাফসির, মাসয়ালা-মাসায়িল ইত্যাদি।
কিচ্ছা–কাহিনির সূচনা
খুলাফায়ে রাশিদিনের শেষের দিক দিয়ে কিচ্ছা-কাহিনির সূত্রপাত ঘটে। এরপর ইসলামি সাম্রাজের বিভিন্ন মসজিদে ক্রমান্বয়ে কিচ্ছা-কাহিনির আসর বৃদ্ধি পেতে থাকে। আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নবিজির যুগ, আবু বকরের যুগ এবং উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এর যুগে কিচ্ছা-কাহিনীর কোন অস্তিত্ব ছিল না।’
ইবনু আবি শাইবার বর্ণনায় উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগের কথাও এসেছে যে, তখনও কিচ্ছা-কাহিনি বর্ণনার প্রচলন শুরু হয়নি। মূলত সাইয়িদুনা উমর ইবনুল খাত্তাবের ইন্তিকালের পরপরই ফিতনার দুয়ার খুলে যায়। মুসলিমবিশ্বে নানান ধরনের ফিতনার উদ্ভব ঘটে। তার মধ্যে অন্যতম একটি ফিতনা হলো কাসসাস বা কিচ্ছাকারদের ফিতনা।
একদিন জনৈক কিচ্ছাকার ইবনু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মজলিসে এসে বসলে, তিনি তাকে মজলিস থেকে উঠে যেতে বললেন। ঐ লোক মজলিস ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন ইবনু উমর প্রশাসনের সহযোগিতায় তাকে ঐ মজলিস থেকে বের করে দেন।
এভাবে প্রথম যুগ থেকেই কথক বা কাহিনিকারদের ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছিল। প্রাথমিক যুগে তাদের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা হলেও পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি ঝুঁকতে থাকে। মসজিদে মসজিদে এদের মজলিস জমে। সাধারণ মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এভাবে ওয়াজ-নসিহতের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি দখল করে নেয় এইসব কথক বা কাহিনিকাররা। এদের অধিকাংশই আল্লাহকে ভয় করত না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য থাকতো মজলিসে উপস্থিত লোকজনকে হাসানো, কাঁদানো এবং একধরনের উন্মাদনা সৃষ্টি করা। এ মর্মে তারা আজব আজব কিচ্ছা-কাহিনি শোনাত। এমনকি এসব বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনিকে তারা অনেকসময় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে চালিয়ে দিত।
ইমাম ইবনু কুতাইবা (রহ.) এই বাস্তবতা খুব চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন,
‘কথক বা কিচ্ছাকাররা শ্রোতাদের আকর্ষণ সৃষ্টিতে তৎপর ছিল। কাজেই তারা অত্যন্ত সুললিত কণ্ঠে দুর্বল ও মুনকার হাদিস বর্ণনা করতো। আবার সাধারণ জনগণও ঐসব কিচ্ছাকারদের ওয়াজ শুনতে ব্যাপক আগ্রহী ছিল। আর তারাও এমনসব আজগুবি হাদিস বয়ান করতো, যা সত্যিই হৃদয়কে গলিয়ে দিতো।’
ইমাম আহমাদ ও জনৈক বক্তা
একবার ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল ও ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন (রহ.) বাগদাদের ‘রসফা’ নামক মসজিদে নামাজ পড়ে বসে আছেন। ইতোমধ্যে একজন কিচ্ছাকার বক্তা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ওয়াজ শুরু করে দিল। কিছুক্ষণ পরেই সে ইমাম আহমাদ ও ইবনু মাঈনের সনদে একটি হাদিস বর্ণনা করতে শুরু করল। সে বলতে লাগল—
আহমাদ ইবনু হাম্বল ও ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন আমাদের নিকট হাদিস বর্ণনা করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মানুষ যখন ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এই কালিমা পাঠ করেন, তখন আল্লাহ তায়ালা তার প্রত্যেকটি শব্দ হতে এক-একটা পাখি সৃষ্টি করেন, যার ঠোট স্বর্ণের আর পালক মুক্তোর…।’ এভাবে অবলীলাক্রমে ঐ কথক প্রায় ২০ পৃষ্ঠার মতো হাদিস বর্ণনা করল।
এতে অবাক হয়ে ইমামদ্বয় একে অপরের দিকে তাকালেন। ইবনু মাঈন জিজ্ঞেস করলেন আহমাদ ইবনু হাম্বলকে ‘আপনি কি তার নিকট এই হাদিস বর্ণনা করেছেন?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি এই হাদিসটি এইমাত্রই প্রথম শুনলাম।’
তো ওয়াজ শেষ হলে ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন (রহ.) ইশারায় তাকে ডাকলেন। সে বড় জ্ঞানীর ভনিতা করে দর্পভরে তাঁর নিকট এলো। ইবনু মাঈন (রহ.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তোমার নিকট এই হাদিস বর্ণনা করেছে?’ সে বলল, ‘আহমাদ ইবনু হাম্বল ও ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন।’ তিনি বললেন, ‘আমি হলাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, আর ইনি হলেন আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহ.)। আমরা তো কখনো এ রকম হাদিস শুনিইনি, বর্ণনা করা তো দূরের কথা।’ একথা শোনার পর ঐ বক্তা বলল, ‘বহু দিন যাবত লোকমুখে শুনে আসছিলাম যে, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন একজন নির্বোধ লোক। আজ তার সত্যতা পেলাম। তোমাদের কথায় বোধ হয়, তোমরা দুজন ছাড়া দুনিয়াতে আর কোন ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন আর আহমাদ ইবনু হাম্বল নেই? অথচ আমি ১৭ জন আহমাদ ইবনু হাম্বল ও ইয়াহইয়া ইবন মাঈন থেকে এ হাদিস গ্রহণ করেছি।’ এ কথা বলে লোকটা ইমামদ্বয়কে নানা প্রকার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে ঐ স্থান ত্যাগ করে।
ইমাম আবু হানিফা ও জনৈক বক্তা
এইসব কিচ্ছাকার বক্তারা সবযুগেই সেলিব্রিটি ও ফেমাস হয়ে থাকে। এদের ভিড়ে মানুষ সত্যিকারের আলিমদের চিনতে পারে না। তারই প্রমাণ এই ঘটনাটি—
কুফার জামে মসজিদে ‘যারয়া’ নামে এক বক্তা ছিল। ইমাম আবু হানিফার মা একটা বিষয়ে ফাতওয়া জানতে চাইলেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর চমৎকার একটা সমাধান দিলেন। কিন্তু তার মা তা গ্রহণ না করে বললেন, ‘যারয়ার ফয়সালা ছাড়া আমি আর কারও ফয়সালা গ্রহণ করব না।’ অগত্যা বাধ্য হয়ে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তার মাকে নিয়ে যারয়ার কাছে গেলেন এবং বললেন, ‘ইনি আমার মা। তোমার কাছে এ বিষয়ে ফাতওয়া জানতে চান।’ যারয়া ইমামকে বলল, ‘এসব বিষয়ে আমার চেয়ে তো আপনিই অধিক পারদর্শী। আপনিই এর সমাধান দিন।’ ইমাম আবু হানিফা বললেন, ‘আমি তো এভাবে এর সমাধান দিয়েছি। কিন্তু আমার মা তোমার ফয়সালা শুনতে চান।’ যারয়া বলল, ‘আপনি যেভাবে এর সমাধান দিয়েছেন, সেটাই এর সঠিক ও প্রকৃত সমাধান।’ যারয়ার এ কথায় ইমাম আবু হানিফার মা সন্তুষ্ট হন এবং সেখান থেকে ফিরে আসেন।
ইমাম ইবনু জারির ও জনৈক বক্তা
বাগদাদে এক ওয়াজ মাহফিলে এক বক্তা ‘হয়ত বা আপনার রব আপনাকে মাকামে মাহমুদে পৌঁছাবেন।’এ আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহ তায়ালার সাথে আরশের উপর উপবেশন করবেন।’ ইমাম ইবনু জারির তাবারি (রহ.) এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি তার ঘরের দরজায় লিখে দেন—‘তিনি পবিত্র, তার কোন অন্তরঙ্গ সাথী নেই। আর নেই তাঁর সঙ্গে আরশের উপবেশন করার মত কোন উপবেশনকারী।’
এর ফলে বাগদাদের জনসাধারণ ইমাম ইবনু জারিরের ওপর ভীষণভাবে ক্ষেপে যায় এবং পাথর নিক্ষেপ করে তার বাড়ি-ঘর তছনছ করে দেয়। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁর ঐ দরজাখানি পাথরের আঘাতে ভেঙে চুরমার করে দেয় এবং তার ওপর চড়াও হয়, সূত্র অধিকার নিউজ।
এ জাতীয় আরও বহু কিচ্ছা-কাহিনি কথক বা ওয়ায়েজরা হাদিস নামে লোকসমাজে চালু করে দেয়। প্রথম শতাব্দিতে এর প্রভাব তেমন একটা না থাকলেও পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে এগুলো বিস্তৃতি লাভ করে। আমাদের আলিম সমাজও তাদের রচিত মিথ্যা কিচ্ছা-কাহিনিগুলো চিহ্নিত করে তা জাল হাদিসের গ্রন্থাবলিতে সন্নিবেশিত করেন। ফলে জাল হাদিস ও সহিহ হাদিসের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নিরূপিত হয়ে যায়। কিন্তু যুগে যুগেই মানুষ আলিমদের মুখ থেকে কুরআন ও সুন্নাহর কথা শোনার চেয়ে জাহেল বক্তাদের মুখ থেকে মিথ্যা কিচ্ছা-কাহিনি শোনার প্রতিই বেশি আকৃষ্ট থাকে। ফলে এ সমস্ত কাসসাস বা কিচ্ছাকার বক্তাদের বাজার সবসময় সরগরম থাকে। সাধারণ মানুষ মুহাক্কিক আলেমদের তুলনায় এদেরকে নিয়েই বেশি মেতে থাকে।