Lead Newsশিল্প ও বাণিজ্য

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের অর্থনীতি

কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অর্থনীতি রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয়ের ওপর ভর করে ফের ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা যেমনি শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করার আস্থা ফিরে পেয়েছে তেমনি সাধারণ মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে যুক্ত হচ্ছেন কাজে। একইসাথে পুরো করোনাকালীন সময়ে সচল থাকা কৃষিখাতে আরো প্রাণ চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে।

পুঁজিবাজারে চাঙ্গাভাব, দোকান ও বিপনি বিতানে বেচা-কেনা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি আর্থিক খাতের বিভিন্ন সূচক অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসার সুস্পষ্ট আভাস দিচ্ছে। বৈশি^ক ও দেশীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশংসা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন করোনায় প্রাণহানির ঘটনা যদি বড় আকারে আর না ঘটে,তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন করোনাভাইরাস অতিমারির মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার মত সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে অর্থনীতির কালো মেঘ কেটে যাচ্ছে। পাশাপাশি ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাজারে নগদ অর্থের সরবরাহ সচল রেখে অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকার গত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা বন্ধ এবং মানুষ ঘরবন্দি থাকায় অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক দূর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর অর্থনীতির চাকা আবার সচল হতে শুরু করে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বাসসকে বলেন,‘সামগ্রিক পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে স্পষ্ট হেেয়ছে যে, ব্যবসায় আস্থা বাড়তে শুরু করেছে। এর বড় কারণ হলো সরকার ও কেন্দ্রিয় ব্যাংক ঘোষিত ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ, যা নানাভাবে বাজারে নগদ অর্থ সরবরাহ করছে।’
তিনি বলেন,প্রণোদনা প্যাকেজের ৫০ শতাংশ হলো পুনঃঅর্থায়ন স্কীম। ব্যাংক রেটে কেন্দ্রিয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে টাকা দিচ্ছে। এতে করে ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি বেশ ভাল। সুতরাং এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা বুঝেছেন,তারা চাইলে টাকা পাবেন। এ সবে ব্যবসায়ীদের আস্থা আরো দৃঢ় হচ্ছে।

ইতোমধ্যে বড় শিল্প-কারখানা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ঘোষিত ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের ৫৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয়েছে।

আতিউর রহমান আরও বলেন, রফতানিতে চাহিদা বাড়ছে,বিদেশিরা করোনায় সৃষ্ট নিউ নরমাল লাইফ মেনে নিয়ে ব্যবসাকেন্দ্র চালু করেছে। সামনে বড় দিন। তাই তৈরি পোশাক রফতানি বেড়েছে। ব্যবসায় আস্থা বৃদ্ধির আর এক কারণ হলো-রেমিটেন্স প্রবাহের উল্লম্ফন। রেমিটেন্স বাড়লে যেটা হয় অর্থনীতিতে তারল্য বৃদ্ধি পায়। যা পরোক্ষভাবে ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ পেতে সহায়তা করে। যেটা এই মুহূর্তে আমাদের জরুরি প্রয়োজন।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই) রফতানি আয় করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে রফতানি হয়েছে ৩৯১ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য, যা বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই মাসের তুলনায় শুণ্য দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। এদিকে, করোনা অতিমারির মধ্যে গত কয়েক মাস যাবৎ রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েই চলেছে। প্রতি মাসে নিয়মিতভাবে রেমিটেন্স আয়ে রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। সর্বশেষ গত জুলাই মাসে ২৬০ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠান প্রবাসীরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বেশি রেমিটেন্স এর আগে কখনই আসেনি।

রপ্তানি আয় ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়ে রফতানিমূখী তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক ও ভারটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনির হোসেন বাসসকে বলেন,করোনা অতিমারির কারণে মার্চ,এপ্রিল ও মে মাসে কমহারে পণ্য জাহাজীকরণ ও পশ্চিমা দেশগুলোতে ঘরবন্দি অবস্থা বিরাজ করায় রফতানি যথেষ্ট কম ছিল। এখন ওইসব দেশে বিপনী বিতান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। সামনে বড়দিন। তাই রফতানি ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে।

তবে তিনি মনে করেন বড়দিন উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশে পোশাক পণ্য মূলত জুলাই ও আগস্টে জাহাজীকরণ হয়। সুতরাং জুলাই ও আগস্টে রফতানিতে যে প্রবৃদ্ধি দেখা যাবে, সেই প্রবৃদ্ধি হয়ত আগামী মাসগুলোতে নাও থাকতে পারে। কিন্তু করোনার ধাক্কা কাটিয়ে রফতানিতে ইতিবাচক যে ধারা তৈরি হয়েছে,সেটা বজায় থাকবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এদিকে, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে খুচরা পর্যায়ের ৯০ শতাংশ দোকান ইতোমধ্যে খুলেছে। তবে আড়ত বা বড় পরিসরের যেসব পাইকারি দোকান রয়েছে-সেগুলো এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি। সংগঠনটির হিসাবে এবারের ঈদুল আজহায় ১২ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। আর খুচরা পর্যায়ে বেচাকেনা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানান,খুচরা পর্যায়ের অধিকাংশ দোকান ইতোমধ্যে খুলেছে। কোরবানীর সময় বিক্রি ১০ শতাংশ বেড়েছে। তবে তিনি মনে করেন, করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এসএমইর জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা যদি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যথাযথভাবে না পান,তাহলে তাদের একটি অংশ আর ব্যবসায় ফিরে আসতে পারবেন না।

এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যকেজ ঘোষণা করে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)’র সভাপতি শামস মাহমুদ মনে করেন গত এক মাসে অর্থনীতিতে খানিকটা প্রাণ চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। পর্যটন ও হোটেল ছাড়া অন্যান্য সেবা খাতে মানুষ কাজে ফিরতে শুরু করেছে। তিনি বাসসকে বলেন,করোনা অতিমারিতে যারা কর্মহীন হয়েছে,তাদের কর্মসংস্থানে ফিরিয়ে আনা একটা চ্যালেঞ্জ।এর জন্য এসএমই খাতকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে উজ্জীবিত করার প্রতি সরকারের মনোযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে,বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড (স্ট্যানচার্ট) ব্যাংক গত ১২ আগস্ট এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে রফতানি আয় ও রেমিটেন্সের হাত ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরাও আত্মবিশ^াস ফিরে পেতে শুরু করেছেন। ব্যাংকটি এও বলেছে,বিশে^র অন্যান্য দেশের তুলনায় করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি বাংলাদেশ দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে পারবে। আর রেমিটেন্স বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। ফলে আমদানি ব্যয় মেটানো নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।

স্ট্যানচার্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ এডওয়ার্ড লি বলেছেন,আশিয়ান ও দক্ষিণ এশিয়ার দু’টি দেশ ২০২০ সালে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে। বাংলাদেশ এর মধ্যে একটি। এখন বাংলাদেশ ব্যবসায় অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে দেশিয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে,করোনা অতিমারির দ্বিতীয় প্রান্তিকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে শুরুর দিকের তুলনায় ব্যবসা পরিচালনার আস্থা বেড়েছে।
আতিউর রহমানের অভিমত, বাংলাদেশের কৃষিখাত বরাবর ভাল করে। এবারও করোনা অতিমারির শুরু থেকে কৃষি সচল ছিল। প্রণোদনা প্যাকেজ ছাড়াও সার,বীজসহ পর্যাপ্ত কৃষি উপকরণ বিতরণ করায় কৃষিতে এখন আরো চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার বা করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বড় সহায়তা করছে।

কমনওয়েলথ সচিবালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার মত সাহসী সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য ভাল ছিল।

তিনি বাসসকে বলেন,করোনায় যদি বড় আকারে প্রাণহানি না ঘটে, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে। তিনি করোনায় সৃষ্ট বৈশি^ক বাণিজ্যিক সুবিধা বিশেষ করে চীন থেকে স্থান্তারিত বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনার বিষয়ে সরকারকে আরো তৎপর হওয়ার পরামর্শ দেন।

ঈদুল আজহার ছুটির পর থেকেই চাঙ্গাভাব দেখা যাচ্ছে দেশের পুঁজিবাজারে। যা স্পষ্টত অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত বহন করছে। দেশের দুই পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সূচক ও লেনদেন উভয়ই বেড়ে চলেছে। এর পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণও বাড়ছে।

সূত্রঃ বাসস

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen − sixteen =

Back to top button