কূটনীতি

কী বার্তা নিয়ে ঢাকায় এলেন শ্রিংলা?

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা গতকাল অনেকটা আকস্মিক ঢাকা সফরে এলেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ডেস্কের প্রধান। কূটনৈতিক সূত্র জানান, শ্রিংলা গতকাল ঢাকা এসে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রাতে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে গণভবনে এ বৈঠক হয়।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও অন্য কয়েকটি কর্মসূচি শেষে আজ নয়াদিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাশ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কের গভীরতা বোঝাতেই পররাষ্ট্র সচিবের এ সফর।

গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তেজগাঁও কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে অবতরণ করে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবকে বহনকারী ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিমান। তিনি রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ওঠেন। সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় শ্রিংলার সঙ্গে ছিলেন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাশ, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার ডেস্কের প্রধান স্মিথা পন্থ।

ভারতীয় কূটনৈতিক সূত্র জানান, দুই দেশের মধ্যে এমনিতেই অত্যন্ত সুসম্পর্ক বিদ্যমান। তাই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে একটা যোগাযোগ রক্ষা করতে চেয়েছে দুই দেশ। কারণ মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান স্থগিত হওয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসতে পারেননি। সেজন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করার জন্য এটি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর একটি উদ্যোগ। হর্ষবর্ধন শ্রিংলার এ ভিজিট ছিল পুরোটাই আনঅফিশিয়াল।

সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগের খুবই প্রশংসা করেছেন। বিশেষত পররাষ্ট্র সচিবকে পাঠিয়ে একে অন্যের মধ্যে বার্তা পাঠানো এবং সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এমনিতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ করোনা মহামারীর মধ্যে কারও সঙ্গে দেখা করেননি। এটিই বাইরের বিদেশি প্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ।

সূত্র জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতে দুই দেশের উন্নয়ন অংশীদারিত্ব, কানেকটিভিটি জোরদার, কভিড-পরবর্তী অর্থনীতি পুনর্জাগ্রতকরণ, কভিডের প্রভাব মোকাবিলায় সহযোগিতা, ভ্যাকসিনসহ কভিড অ্যাসিস্ট্যান্স খাতে সহযোগিতা, যৌথভাবে মুজিববর্ষ উদ্যাপন, ভারতের পক্ষ থেকে একটি ডাকইিকট উন্মোচন এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভারতের দেওয়া ১০টি লোকোমোটিভের জন্য উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।

তিনি বলেছেন, এটা বাংলাদেশকে খুব সাহায্য করবে। এখন লোকোমোটিভের স্বল্পতা আছে। প্যাসেঞ্জার ও ফ্রেইটের জন্য উপকারে আসবে। ভারতের পক্ষ থেকে একটি বিজনেস, অফিশিয়াল ও মেডিকেল ক্ষেত্রে একটি ট্রাভেল বাবলের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ট্রাভেল বাবল মানে এয়ার বাবল। দ্বিপক্ষীয়ভাবে তৃতীয় কোনো দেশকে সম্পৃক্ত না করে দুই দেশের মধ্যে ফ্লাইট চালানো। ভারতের এ ব্যবস্থা আছে ফ্রান্স, জার্মানি, মালদ্বীপ ও খুব সম্ভবত সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে। এটা করলে লোকের অনেক সুবিধা হবে। করোনাভাইরাসের পরিপ্রেক্ষিতে যে কোনো দুই শহরের মধ্যে এ সার্ভিস চলবে।

দ্বিপক্ষীয়ভাবে এটার আলোচনা হলো তবে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে এয়ারলাইনসগুলো। এখন ভারত বিজনেস ও মেডিকেল ভিসা দিচ্ছে খুব লিমিটেড আকারে আকাশপথে যাতায়াতের জন্য। ফ্লাইট অ্যাভেইলেবল হলে মানুষ এটি অ্যাভেইল করতে পারবে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে নিরাপদ, সুরক্ষিত ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পক্ষে ভারতের অবস্থান জানানো হয়েছে।

এ ছাড়া নিকটতম সময়ে যৌথ পরামর্শক কমিশনের বৈঠকের বিষয়েও দুই দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ২০১৮ সালের ফেব্র“য়ারিতে শেষ বৈঠক হয়েছিল। তার ভিত্তিতে এবার ভার্চুয়াল ফরম্যাটে আলোচনা হবে। সেখানেই সব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যত প্রেক্ষাপট আলোচনা হবে। সেখানে বিদ্যমান প্রজেক্টগুলোর অগ্রগতি বিশেষ গুরুত্ব পাবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদ্যাপনে উভয় পক্ষই অপেক্ষা করছে এটা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

গত কয়েকদিনে অনেক পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর ওপর অনেক আর্টিক্যাল বেরিয়েছে। এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বহুমুখী, ট্যুরিজম, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা, জ্বালানি, সংস্কৃতি, ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি, নিউক্লিয়ার সায়েন্স, মহাকাশ, তথ্যপ্রযুক্তি, মানুষে মানুষে সম্পর্ক অনেক জোরালো। এটি দুই দেশের নেতাদের ভিশনের টেস্টিমনি। এ খাতগুলোয় সহযোগিতা আরও জোরদার করা হচ্ছে। নতুন প্রযুুক্তি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ইকোলজি, কনজারভেশন, ইয়ুথ টু ইয়ুথ সম্পৃক্ততা বাড়ানো হবে। এ সফরে বার্তা কী জানতে চাইলে ভারতীয় কূটনীতিক বলেন, মেসেজ হলো শুভ কামনা, গুড উইল। মেসেজ যে আমাদের বন্ধুত্ব কত নিবিড়। সেজন্য বিশেষ করে কভিডের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব এসেছেন যাতে এ মেসেজটা জানাতে যে, আমাদের বন্ধুত্ব কতটা নিবিড়।

অন্যদিকে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফর আগ্রহের সৃষ্টি করেছে নানা মহলে। তবে এ সফর হঠাৎ বা আকস্মিক কিছু নয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার ঢাকা সফর কোনো ঝটিকা নয়, নিয়মিত।

তিনি বলেন, আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে অনেক ইন্টার‌্যাকশন হয়। তবে এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে সে হিসেবে কমই হয়েছে। সব সময় আলোচনায় সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি থাকে। তবে এবার কভিড-১৯ নিয়ে সহযোগিতার বিষয়টি থাকছে। তাদের দেশে (ভারতে) এখন করোনার ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চলছে। ভ্যাকসিন নিয়ে আমরা কে কোন পর্যায়ে আছি সে বিষয়ে আলোচনা হবে। মাসুদ বিন মোমেন বলেন, গত ছয় মাসে বেশ কিছু বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে ট্রান্সশিপমেন্ট ও রেলওয়ের সহযোগিতা ত্বরান্বিত হয়েছে।

মোমেন আরও বলেন, বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের সম্পর্ক অনেক গভীর। এ সম্পর্কের যত্ন নেওয়া লাগে যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়। এ ছাড়া সম্প্রতি ভারতের মিডিয়ায় কিছু কাল্পনিক নিউজ হয়েছে, সেগুলো নিয়ে যাতে সম্পর্কের কোনো গ্যাপ না থাকে এজন্যও আলোচনা প্রয়োজন। গত জানুয়ারিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এটি শ্রিংলার দ্বিতীয় বাংলাদেশ সফর। এর আগে মার্চের শুরুতে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তিনি। তিন বছর ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালনের পর গত বছর জানুয়ারিতে বিদায় নেন শ্রিংলা। (বিডি প্রতিদিন)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 + thirteen =

Back to top button