Lead Newsঅপরাধ ও দূর্ঘটনানগরজীবন

নমুনা পরীক্ষায় অনিয়ম, প্রতিবাদ করায় রোগী ও সাংবাদিকের ওপর হামলা

রাজধানী ঢাকার মুগদা হাসপাতালে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহে অবস্থাপনার প্রতিবাদ করায় কর্তব্যরত আনসার সদস্যদের হামলার শিকার হয়েছেন এক রোগী। ঘটনার ছবি তুলতে যাওয়ায় হামলার শিকার হয়েছেন, একটি জাতীয় দৈনিকের চিত্র সাংবাদিকও। কর্তৃপক্ষ বলছে, দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কোভিড নাইনটিন পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহে বিড়ম্বনার শিকার এই রোগী জানান তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। করোনা উপসর্গ আর মানসিক অস্থিরতার মধ্যে কোভিড পরীক্ষা করাতে এসে, দীর্ঘসূত্রিতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে, অধিকাংশ সেবা প্রত্যাশীর বিস্তর অভিযোগ।

করোনা শনাক্তের ফলাফল পেতে আসা মানুষরা বলেন, চারদিন পর বুথে গিয়ে বললাম আমার রিপোর্টটি আসেনি। তখন তারা বলেন, অভিযোগ লিখে যান। এরকম করে তিনবার অভিযোগ করেছি, তারপরও ফলাফল আসেনি।

পুরো ঘটনাঃ

মায়ের করোনা পরীক্ষা করানোর জন্য মুগদা জেনারেল হাসপাতালে গিয়েছিলেন রাজধানীর মুগদার দক্ষিণ মান্ডা এলাকার বাসিন্দা শাওন হোসেন। ভোর পাঁচটা থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও পরীক্ষা করানোর অনুমতি পাননি। এ নিয়ে কর্তব্যরত আনসার সদস্যদের সঙ্গে তাঁর বাগ্‌বিতণ্ডা হয়।

একপর্যায়ে আনসার সদস্যরা তাঁর কলার ধরে হাসপাতালের ক্যাম্পে নিয়ে যান। এই ঘটনার ছবি তুলতে গেলে আনসার সদস্যরা লাঞ্ছিত করেন দুই ফটো সাংবাদিককে।

আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় এই ঘটনা ঘটে। আনসার সদস্যদের হাতে মারধরের শিকার শাওন হোসেন জানিয়েছেন, তাঁর মা ক্যানসারের রোগী। কেমোথেরাপি দিতে হলে করোনা শনাক্তের পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। লাইনের ক্রম অনুযায়ী তাঁর আজই পরীক্ষা করানোর কথা। অথচ অসুস্থ মাকে নিয়ে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও তাঁকে না করে দেওয়া হয়।

এই ঘটনায় হামলার শিকার দুই ফটোসাংবাদিক হলেন ‘দেশ রূপান্তর’–এর রুবেল রশীদ এবং ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’–এর জয়িতা রায়। আনসার সদস্যদের হামলায় রুবেল রশীদের ক্যামেরার লেন্সের ফিল্টার ভেঙে গেছে।

ভুক্তভোগী শাওন হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত দুবার মুগদা হাসপাতাল থেকেই করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করিয়ে তিনি মাকে কেমোথেরাপি দিয়েছেন। গত ২০ জুন তৃতীয়বারের মতো বুথে পরীক্ষা করান। কিন্তু সময়মতো ফল না পেয়ে ২৩ জুন তিনি অভিযোগ বক্সে লিখিতভাবে বিষয়টি জানান। তার পরও ফল না পাওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী ২৬ জুন তিনি নোটিশ বোর্ডে নোটিশ দিয়ে যান। পরদিন হাসপাতালে গিয়ে আবারও নোটিশ দেন। কিন্তু তাতেও কাজ না হলে বৃহস্পতিবার পুনরায় তাঁর মাকে পরীক্ষা করানোর জন্য হাসপাতাল থেকে বলা হয়।

শাওন হোসেন বলেন, করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করানোর জন্য হাসপাতালের সামনে দুটি লাইন থাকে। একটি লাইন যাঁরা বিনা মূল্যে বুথে পরীক্ষা করাবেন তাঁদের। অন্যটি যারা ২০০ টাকা দিয়ে হাসপাতালে পরীক্ষা করাবেন তাঁদের। মাকে নিয়ে তিনি ভোর পাঁচটায় হাসপাতালে পরীক্ষা করানোর লাইনে দাঁড়ান। লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিরা নিজেরাই একটি ক্রম করেন। সেই অনুযায়ী তাঁর ক্রম ছিল ৩৬ নম্বরে।

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানান, সকাল সাড়ে ৯টায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা পরীক্ষার জন্য টোকেন দেওয়া শুরু করে। প্রথমে যাঁরা বিনা মূল্যে বুথে পরীক্ষা করাবেন তাঁদের টোকেন দেওয়া হয়। এরপর হাসপাতালে যাঁরা পরীক্ষা করাবেন তাঁদের টোকেন দেওয়া শুরু হয়। আনসার সদস্যদের হাতে মারধরের শিকার শাওন হোসেন বলেন, লাইনে অপেক্ষমাণ ব্যক্তিরা যাতে সুশৃঙ্খলভাবে টোকেন সংগ্রহ করেন, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আনসার সদস্যদের। কিন্তু তাঁরা কিছুই না করে ফটকে বসেছিলেন। তখন তিনি সবার সঙ্গে কথা বলে দায়িত্ব নিয়ে একজন একজন করে টোকেন সংগ্রহ করার জন্য পাঠাচ্ছিলেন। ৩৩তম ব্যক্তি যাওয়ার পরই যাঁরা টোকেন দিচ্ছিলেন তাঁরা আর টোকেন দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী অন্তত ৪০ জনকে তাঁদের টোকেন দেওয়ার কথা। তাঁর ক্যানসার–আক্রান্ত মা ৩৬ নম্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

শাওন বলেন, টোকেন না দেওয়ার কারণ জানতে তিনি এগিয়ে যান। যাঁরা টোকেন দিচ্ছিলেন তাঁরা কোনো জবাব না দিয়েই সেখান থেকে চলে যান। তখন আনসার সদস্যদের কাছে তিনি কারণ জানতে চান। তাঁদের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে তাঁর কলার ধরে ভেতরের আনসার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে লাঠি দিয়ে দুটি বাড়ি দেওয়া হয়। একজন আনসার সদস্য তাঁর হাত বাঁধার জন্য রশিও নিয়ে আসেন। পরে মুগদা থানা থেকে পুলিশ আসে। তারাও ঘটনার জন্য তাঁকে দায়ী করে। শেষমেশ তাঁর পূর্ণাঙ্গ নাম–ঠিকানা লিখে নিয়ে যায়। এ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা না বলার জন্যও শাসানো হয় তাঁকে।

ফটো সাংবাদিক জয়িতা রায় বলেন, সকাল সাড়ে ১০টায় তিনি মুগদা হাসপাতালে পৌঁছেই আনসার সদস্যদের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা হচ্ছে দেখতে পান। তখন ছবি তুলতে গেলে একজন আনসার তেড়ে আসেন। তাকে চড় মারতে উদ্যত হন। তিনি কোনো রকম সরে পড়লে চড়টি তাঁর গায়ে লাগেনি। তাঁর এই পরিস্থিতি দেখে এগিয়ে আসেন ফটোসাংবাদিক রুবেল রশীদ।

রুবেল রশীদ জানান, শাওন হোসেনকে কলার ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন আনসার সদস্যরা। সেই ছবি তুলতে গেলে এক আনসার সদস্য তাঁকে মারতে উদ্যত হন। এ সময় একটি চড় ক্যামেরায় লাগলে লেন্সের প্রটেক্টর ভেঙে যায়। এ সময় আনসার সদস্যরা খুব বাজে আচরণ করছিলেন বলেও জানান তিনি।

সাংবাদিকদের তোলা ছবি থেকে দেখা যায় দুজন আনসার সদস্য সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থেকে মায়ের করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করাতে না পারা ছেলেটির কলার ধরে টানাহেঁচড়া করছেন। পেছন পেছন তাঁর মা হেঁটে যাচ্ছেন। এঁদের একজন আনসার সদস্য আফসারুল আমিন ফটো সংবাদিকদের ছবি তুলতে বাধা দিচ্ছিলেন। তবে লাঞ্ছিত দুই ফটোসাংবাদিক জানিয়েছেন সেখানে আরও কয়েকজন আনসার সদস্য ছিলেন যাঁরা খুব বাজে আচরণ করছিলেন।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত মুগদা জেনারেল হাসপাতাল আনসার ক্যাম্পের সহকারী কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বলেন, পরীক্ষা করাতে না পেরে ছেলেটি (ভুক্তভোগী শাওন হোসেন) তাঁদের সঙ্গে অকথ্য ভাষায় কথা বলছিলেন। তখন সেখানে উপস্থিত একটি সংস্থার সাদাপোশাকের সদস্য ছেলেটিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ক্যাম্পে নিয়ে যেতে বলেন। তাঁরা সেই কাজটিই করেছেন। পরে মুগদা থানার একজন উপপরিদর্শক এসে ছেলেটির নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে যান। ছেলেটিকে কোনো মারধর করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

মুগদা হাসপাতালের করোনা পরীক্ষার টোকেন দেওয়ার বিষয়টি তদারকি করেন হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার অনিমেষ। একটি সূত্র থেকে তাঁর মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর সামনে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাঁরা বুথ এবং হাসপাতালে পরীক্ষা করানোর জন্য মোট ৫০ জন করে ১০০ জনকে টোকেন দিয়েছেন। সে হিসাবে লাইনের ৩৬ নম্বর যিনি দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর অবশ্যই পরীক্ষা করাতে পারার কথা। তাঁর দাবি, ক্যানসার–আক্রান্ত কোনো রোগী থাকলে তাঁর কাগজপত্র দেখে সবার আগে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করেন তাঁরা।

তবে আনসার ক্যাম্পের সহকারী কমান্ডার রফিকুল ইসলাম জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সব সময়ই জরুরি প্রয়োজনের অজুহাতে পরীক্ষা করানোর কিছু টোকেন তাদের হাতে রেখে দেয়। আগে এই সংখ্যাটি ছিল ১৪-১৫ টি। এখন ৬-৭ টি রেখে দেওয়া হয়। আর লাইনে দাঁড়ানো মানুষজন তাঁদের ওপর চড়াও হন।

মুগদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রলয় কুমার সাহা বলেন, অকথ্য ভাষায় কথা বলায় আনসার সদস্যরা একটি ছেলেকে টানাহেঁচড়া করেছেন বলে তিনি জানতে পেরেছেন। তবে কোনো সাংবাদিককে মারধর করা হয়নি। গালমন্দ করে থাকতে পারেন। তবে এ নিয়ে কেউ তাঁর কাছে কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেননি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

20 + seven =

Back to top button