ফেরাউন কেন অতি আমলানির্ভর ছিল
কয়েকদিন আগে বেশ হাঁকডাক করে ৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করা হলো। এ রকম মসজিদ নির্মাণ করা হবে সর্বমোট ৫৬০টি। মসজিদগুলো নির্মিত হচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে।
মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র পরিচালনা নীতিমালা ২০২১ অনুসারে উপজেলা, জেলা পর্যায়ে অবস্থান অনুযায়ী মসজিদ পরিচালনা কমিটির প্রধান হবেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা প্রশাসক। তারাই মসজিদ পরিচালনা করবেন এবং তারাই মসজিদের জনবল নিয়োগ দেবেন। এ সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
স্বভাবতই তারা ভেবেছিলেন, মসজিদগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব তারাই পেতে যাচ্ছেন। তারা দাবি করেছেন, দেশের প্রতি জেলায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অফিসের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
ইসলামিক মিশন, প্রকাশনা, ইমাম প্রশিক্ষণ অ্যাকাডেমি, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ফাউন্ডেশনের বিভাগীয় ও জেলা অফিসেও। খুব স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান বলে, দেশে একটা বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান থাকার পরও এই মসজিদগুলোর পরিচালনা আমলাদের হাতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
কিছুদিন আগে আরেক খবরে জানা যায়, দেশের প্রথম শ্রেণির পৌরসভাগুলোয় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসাবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
১ জুন মেহেরপুর ও কক্সবাজার পৌরসভায় সরকারের সহকারী কমিশনার পদের দুই কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের ৩২৮ পৌরসভার মধ্যে ১৯৪টি ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হবে।
এ পদক্ষেপের ব্যাখ্যায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলেছে, প্রধান নির্বাহী না থাকায় পৌরসভার আয় বাড়ানোসহ প্রশাসনিক কাজে বিঘ্ন হচ্ছিল।
পৌরসভার কার্যক্রমকে শৃঙ্খলায় আনতে প্রধান নির্বাহী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এমনিতেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতন দিতে না পারা পৌরসভাগুলো নতুন দুশ্চিন্তায় পড়েছে এই সিইওদের বেতন নিয়ে। বলা বাহুল্য, এর চেয়ে আরও বড় দুশ্চিন্তা হিসাবে হাজির হয়েছে পৌরসভায় সরকারের আমলাদের সরাসরি খবরদারি।
নজিরবিহীনভাবে দেশে অন্তত দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে সরকারি আমলাদের পদায়ন করা হয়েছে কয়েক মাস আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সবার আপত্তির পরও এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
যৌক্তিকভাবেই আমরা অনুমান করতে পারি, সামনের দিনগুলোয় এ প্রবণতা বাড়বে। আমলাদের সবকিছু করতে চাওয়ার ব্যাপারে প্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ করেছেন এমনকি সরকারদলীয় লোকজনও। করোনার সময়ে ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে জেলাগুলোতে সমন্বয়ের দায়িত্ব সচিবদের দেওয়া নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তাদের ক্ষোভ অযৌক্তিক নয়, একজন রাজনৈতিক নেতা এ সমাজের জনগণের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পৃক্ত থাকেন; তাই সেই দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতার হাতে থাকা যৌক্তিক। এ করোনার মধ্যেই স্বাস্থ্য বিভাগের একটি নিয়োগ নিয়ে এমনকি সরকারদলীয় চিকিৎসক সংগঠন স্বাচিপও খুব তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপোর (সিএমএসডি) পরিচালক হিসাবে ইতিহাসে প্রথম প্রশাসনিক আমলা (ডাক্তার নন) নিয়োগ করা হয়েছে।
ঘটনাগুলো খুব সাম্প্রতিক সময়ের, কিন্তু দীর্ঘদিন থেকেই আমলারা এমন সব জায়গায় তাদের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছেন, যা তাদের কার্যপরিধির মধ্যে পড়ার কোনো কারণ নেই। আরেকটি কিছুটা পুরোনো কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখে নেওয়া যাক।
আমরা লক্ষ করেছি, উপজেলা চেয়ারম্যানরা নিয়মিত বিরতিতে একযোগে ঢাকায় আসেন; এসে নানা দাবিদাওয়ার সঙ্গে উল্লেখ করেন-তাদের উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) অহেতুক খবরদারির কারণে তারা কাজ করতে নানা সমস্যায় পড়েন।
সর্বশেষ এ বছরের জানুয়ারিতে ঢাকায় এসে সংবাদ সম্মেলন করে তারা স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, আইনে উপজেলাকে প্রশাসনিক একাংশ ঘোষণা করা হয়েছে, যার প্রশাসনিক কাঠামো নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ।
উপজেলা পরিষদ আইনের তৃতীয় তফসিলে ১২টি মন্ত্রণালয়ের উপজেলাধীন ১৭টি বিভাগকে উপজেলা পরিষদের কাছে কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাদের কার্যাবলিসহ হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা আরও জানান, আইনকে বিবেচনায় না নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর বিভিন্ন সময়ে পরিপত্র জারি করছে।
এর মাধ্যমে উপজেলার সব বিভাগের কার্যাবলি নিষ্পত্তির জন্য গঠিত প্রায় শতভাগ কমিটিতে ইউএনওকে সভাপতি করা হয়েছে। এ ১৭টি বিভাগের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তাও ইউএনও। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুমোদন ছাড়া সব কাজ কমিটিপ্রধানের ক্ষমতাবলে নিয়ন্ত্রণ করছেন ইউএনও।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হচ্ছেন মূলত আওয়ামী লীগের নেতারাই। তাহলে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতায়িত করতে আপত্তি কেন সরকারের? সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি বাধ্য হচ্ছে আমলাতন্ত্রের দাবি মেনে নিতে?
এ প্রসঙ্গে সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের ১১ অনুচ্ছেদটি একটু দেখে নেওয়া যাক : ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’
এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে কোনো ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়িত হওয়ার কথা। এর সঙ্গে আমরা যদি স্থানীয় শাসনবিষয়ক অনুচ্ছেদ ৫৯ পড়ি, তাহলে দেখতে পাব বাংলাদেশের সংবিধান চেয়েছে ‘নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা’ এবং তাদের হাতে ‘প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য, জনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনসাধারণের কার্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে’র দায়িত্ব থাকবে।
খুব সহজভাবে বলতে গেলে এটুকু আমরা বুঝি যে, ইউএনওসহ সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী উপজেলা চেয়ারম্যানের অধীনস্থ হিসাবে কাজ করবেন। অথচ দেখা যায়, উপজেলার সব কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে গঠিত কমিটির সভাপতি প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে ইউএনও।
এভাবে একজন নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ইউএনওর অধীনস্থ করা হয়। তবে কি দেশের অন্য সব ক্ষেত্রের মানুষরা অদক্ষ, অযোগ্য ও অসৎ; আর সরকারি আমলাদের (বিশেষ করে প্রশাসনিক) দক্ষতা, যোগ্যতা আর সততা প্রশ্নাতীত? জনগণ কি আদৌ মনে করে এ দেশকে পুরোপুরি এই আমলাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে চালালে দেশ তুলনামূলকভাবে ভালো চলবে?
আমরা যারা এ দেশে বসবাস করি, তারা সহজেই বুঝতে পারি দেশের আমলাতন্ত্রের আসল অবস্থা। তাত্ত্বিকভাবে যদি ধরেও নেই যে তারা অসাধারণ যোগ্য ও সৎ, তবুও কি তাদের হাতে সব দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে?
এটুকু জ্ঞান আমাদের আছে যে, একটা আধুনিক রাষ্ট্রে সরকারি আমলাতন্ত্র থাকবেই। একটি সৎ, দক্ষ আমলাতন্ত্র রাষ্ট্র পরিচালনাকে অনেক সহজ করে তোলে। কিন্তু সরকার মানেই সরকারি আমলাতন্ত্র নয়।
এতে থাকবে নানা রকম স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান, থাকবে অনেক নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানও। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কার্যপরিধি থাকবে এবং তারা নিজেদের মতো করে নিজস্ব পরিচালনা-পদ্ধতি ঠিক করবে।
কখনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠানে যদি ব্যবস্থাপনাগত সংকট দেখা দেয়, প্রয়োজনে সেসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে।
কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো দুর্বলতা বা অন্য কোনো সমস্যার অভিযোগ তুলে সেখানে সরকারি আমলাকে পদায়ন করা কোনোভাবেই সঠিক সমাধান নয়।
সাম্প্রতিককালে আমলাদের নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা বোধকরি সাবেক আমলা পরিকল্পনামন্ত্রীর অহমে আঘাত করেছিল। তখন তিনি আমলাদের অপরিহার্যতা বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, এমনকি ফেরাউনও নাকি আমলা ছাড়া চলতে পারেনি।
পরিকল্পনামন্ত্রী সঠিক ব্যাখ্যা দেননি। ফেরাউনেরই বরং আমলার প্রয়োজন ছিল অনেক বেশি। ফেরাউন তো ঈশ্বর ছিল না, মানে ইচ্ছা করলেই তার সবকিছু হয়ে যেত না।
ফেরাউন হোক বা অন্য যে কোনো সম্রাট, তাকে রাজ্য চালাতে হতো আমলাদের মাধ্যমেই। কারণ সেসব রাজ্যে সেপারেশন অব পাওয়ার্স ছিল না, রাজ্য নানা অঙ্গে বিভক্ত ছিল না, ছিল না রাজ্যের বিভিন্ন স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে স্থানীয় শাসন/সরকার।
একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কোনো সম্রাটশাসিত রাজ্যের ঠিক বিপরীত। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানের চেতনা অনুযায়ী সরকারি আমলাতন্ত্রের কর্মপরিধি নির্ধারণ করতে হবে এবং সেটা মেনে চলতে হবে।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে- দীর্ঘকাল অসাংবিধানিক, অনৈতিক ক্ষমতা উপভোগ করতে দিলে সরকারি আমলাতন্ত্র সেগুলোকে তাদের বৈধ, নৈতিক ক্ষমতা বলে মনে করতে থাকবে।
মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা এ বিষয়টি দেখেছি। তাই আমাদের আমলাতন্ত্রের জন্য স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপযোগী একটা চৌহদ্দি ঠিক করে দিতে হবে এখনই।
লেখকঃ ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট (যুগান্তর)