মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২; কিছু প্রাসঙ্গিকতা
মহাকাশে যাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২। ৩ ও ৪ নিয়েও ভাবছে সরকার। এ নিয়ে শুরু হয়ে গেছে কাজ। এবারের স্যাটেলাইটটির ধরন কেমন হবে তা নির্ধারণে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
গত ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর বাংলামোটরে বিএসসিএল প্রধান কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২-এর ধরন নির্ধারণের জন্য ফ্রান্সের প্রাইসওয়াটার হাউসকুপার্সকে (পিডব্লিউসি) নিয়োগ দিয়েছে বিএসসিএল।
কোন স্যাটেলাইটটি বাংলাদেশের জন্য উপযোগী, তা ঠিক করতে পিডব্লিউসি পর্যালোচনা করে তিন মাসের মধ্যে বিএসসিএলকে পরামর্শ দেবে। এ স্যাটেলাইটটি আবহাওয়া, নজরদারি বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত হবে।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের পরামর্শক নিয়োগ করতে দরপত্র আহ্বান করার পর মোট ২১টি আবেদন জমা পড়ে। সেখান থেকে ৭টি প্রতিষ্ঠানকে দরদাম জমা দিতে বলা হলে চারটি প্রতিষ্ঠান দরদাম জমা দেয়। এরপর সর্বনিম্ন দরদাতা হিসাবে ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটার হাউসকুপার্সকে (পিডব্লিউসি) পরামর্শক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসাবে স্যাটেলাইটের অভিজাত ক্লাবে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশের খরচ হয়েছিল ২ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। মহাকাশে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ একটি কমিউনিকেশন্স স্যাটেলাইট। এটি মূলত নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখতে এবং টিভি চ্যানেলের সম্প্রচারে মূল ভূমিকা রাখছে।
পরবর্তী স্যাটেলাইটটি হাইস্পিড ডাটা ট্রান্সফার এবং দুর্গম এলাকায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছাতে কাজে আসবে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট রয়েছে। এসব স্যটেলাইটের কাজের ধরনও ভিন্ন। কিছু স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সংযোগ, টেলিফোন সংযোগ, উড়ন্ত বিমানে নেটওয়ার্ক প্রদান, দুর্গম এলাকায় নেটওয়ার্ক প্রদান, জিপিএস সংযোগসহ নানা সুবিধা পাওয়া যায়।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কমিউনিকেশন্স স্যাটেলাইট কোম্পানি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর ব্যাপারে প্রস্তুতি শুরু করেছে। উৎক্ষেপণের এক বছর চার মাস পর আয়ের খাতায় নাম লেখাতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। এতে করে দেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর খরচ কমে গেছে।
দর্শকদের জন্য এ তথ্য প্রচার করে যাচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলো। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে দেশে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা ৩৪। এসব টিভি চ্যানেল মূলত হংকংভিত্তিক। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাংলাদেশের সব এলাকা ভালোভাবে কভার করবে।
কিন্তু অরবিট সুবিধামতো জায়গায় না পাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে এর মাধ্যমে চ্যানেলগুলো দেখা যাবে না। এ প্রসঙ্গে তাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, চাইলেই অরবিট পাওয়া যায় না। এটা খালি থাকতে হয়। আবার এটা পেতে অন্যরা অপেক্ষায় থাকে। একটি আন্তর্জাতিক কমিটি এটি নির্ধারণ করে।
বাংলাদেশে প্রথম স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। সে সময় মহাকাশের ১০২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে কক্ষপথ বরাদ্দ চেয়ে জাতিসংঘের অধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নে (আইটিইউ) আবেদন করে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের ওই আবেদনের ওপর ২০টি দেশ আপত্তি জানায়।
পরে ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। স্যাটেলাইটের কাঠামো তৈরি, উৎক্ষেপণ, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ভূ-স্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনার দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানটির। স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ এবং তা কক্ষপথে রাখার জন্য রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ (অরবিটাল স্লট) কেনা হয়েছে।
মহাকাশে এ কক্ষপথের অবস্থান ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সম্পাদিত চুক্তির ভিত্তিতে প্রায় ২১৯ কোটি টাকায় ১৫ বছরের জন্য এ কক্ষপথ কেনা হয়।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ কৃত্রিম উপগ্রহটি একটি জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূ-স্থির উপগ্রহ। এতে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে। বাকি ২০টি বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির জন্য। মহাকাশে উৎক্ষেপণের পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের পর এর নিয়ন্ত্রণ নিতে গাজীপুরের তেলীপাড়া ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় প্রস্তুত গ্রাউন্ড স্টেশন আগামী ৩ মাসের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কার্যক্রম শুরু হবে। স্যাটেলাইটটি কোন ধরনের হবে এবং কী সেবা দেবে, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই সেটি নির্ধারণ করা হবে।
আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বঙ্গবন্ধু-১ থেকে পরিপূর্ণ সেবা গ্রহণ করার পর আমরা যে ধারণা পাব; মূলত তার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট কী হবে, তা নিয়ে চিন্তা করা হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর কার্যক্ষমতা নিঃশেষ হওয়ার পর আমরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-৩ এর কথাও চিন্তা করব।
১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নে বাংলাদেশের সদস্য পদ অর্জনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিস্ময়কর দূরদর্শিতা ছিল।
যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ওপর খাদ্যের জোগান দেওয়াটাও যে দেশে সহজ সাধ্য ছিল না, সে দেশে উপগ্রহের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা কী পরিমাণ দূরদর্শিতার বিষয়, তা ভাবতে গেলেও অবাক লাগে। বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বিপ্লবের যে সূচনা করে গেছেন, তারই ধারাবাহিকতায় তার সুযোগ্য কন্যার হাতে বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশ বিশ্বে ডিজিটাল বিপ্লবের পথ প্রদর্শক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করবে, এটাই প্রত্যাশা।
ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম : সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট
সূত্রঃ যুগন্তর