বিবিধ

মাইকেল জ্যাকসন যে রোগে ভুগেছিলেন

একদিকে চুল ঝরতে শুরু করেছে, অন্য দিকে নাকের দুপাশে প্রজাপতির মতো লালচে গুটি, মাঝে মাঝেই জ্বর আর গাঁটে গাঁটে ব্যথা। ভয় নেই, এসব উপসর্গর সঙ্গে নভেল করোনা ভাইরাসের কোনো যোগ নেই। চেনা লক্ষণ নিয়ে আসা অসুখের নামের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যে খুব একটা পরিচয় আছে তা কিন্তু নয়। রোগের নাম সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমাটোসাস সংক্ষেপে এসএলই। পপ সম্রাট মাইকেল জ্যাকসন এসএলই আক্রান্ত হয়ে ২৩ বছর ভালো ছিলেন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলেছিল তারও।

খটমট নামের এই অসুখে আক্রান্তের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। বেশ কিছু নিয়মের বেড়াজালে রোগীদের থাকতে হয়। নইলে আচমকা বিপদে পড়ার ঝুঁকি থাকে। উপমহাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের ৩.২ জন এই অসুখে ভুগছেন। যদিও আমেরিকার তুলনায় এসএলই আক্রান্তের সংখ্যা যথেষ্ট কম, তাও জনসংখ্যার বিচারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়ে মনের জোর বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের জীবনযাত্রার নিয়মের ব্যাপারে সাহায্যে করতে ইতিমধ্যে ভারতে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তৈরি হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লুপাস ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ান, অটোইমিউন ইন্ডিয়ান, লুপাস ট্রাস্ট ইন্ডিয়ান।

ডাক্তারি মতে সহজ করে বলতে গেলে এসএলই হলো সিস্টেমিক অটোইমিউন ডিজিজ বা কানেকটিভ টিস্যু ডিজিজ। অর্থাৎ শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে নিজের শরীরের বিভিন্ন কোষ ও কলাকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলস্বরূপ আক্রান্ত অংশে প্রদাহ হয়ে ফুলে ওঠে। ফলত সেই অংশের কাজ কর্ম ব্যাহত হয়ে ক্রমশ জায়গাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই রোগের কারণ নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে।

এসএলই হলে শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধি, ত্বক, রক্তবাহী শিরা ধমনি, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, লিভার, কিডনি সহ একে একে সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। তবে ইমিউনো সাপ্রেসিভ ওষুধের সাহায্যে রোগের বাড়বাড়ন্ত অনেকাংশে ঠেকিয়ে রাখা যায়, বললেন ইন্টারন্যাল মেডিসিনের চিকিৎসক দীপঙ্কর সরকার। সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমাটোসাস বা এসএলই মেয়েদের বেশি হচ্ছে।

পাস ফাউন্ডেশন অফ আমেরিকা জানিয়েছে যে ৩৯৩৬ জন লুপাস রোগীর মধ্যে ৩৫৯২ জন নারী এবং বাকি ৩৪৪ জন পুরুষ। বিশ্বব্যাপী সমীক্ষায় জানা গেছে, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের এই রোগের ঝুঁকি ৯ গুণ বেশি। দীপঙ্কর বাবু জানালেন যে অটোইমিউন ডিজিজ এসএলই-র অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শরীরের বিভিন্ন অংশ যখন তখন ফুলে ওঠা এবং ব্যথা করা। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে অ্যাকিউট ও ক্রনিক ইনফ্ল্যামেশন।

লুপাস অসুখটি হলে শরীরে নানা ধরনের অস্বাভাবিক অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এই সব অপ্রয়োজনীয় অকেজো অ্যান্টিবডি শরীরের বিভিন অস্থিসন্ধি যেমন আঙুল, কবজি, হাঁটু, কনুই সহ ত্বক, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, চোখ, স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। ওষুধ দিয়ে এইসব অ্যান্টিবডিকে আটকে না দিলে সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কাজ করার ক্ষমতা কমে গিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে।

এসএলই-র উপসর্গগুলো একনজরে জেনে নেয়া যাক

• হাতের আঙুলের গাঁট, কবজি, কনুই ফুলে গিয়ে ব্যথা হতে পারে, এই অসুখ হলে ৯০ % মানুষই গাঁটের ব্যথায় কষ্ট পান।

• মুখ ও নাকের মধ্যে ছোট ছোট ঘা হয়

• মূত্রনালি সংক্রমণ ও যোনিদ্বারেও আলসার বা ঘা হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যন্ত্রণা করে

• নাকের দুপাশে ডানা মেলা প্রজাপতির মত লালচে র্যাশ বেরোয়, রোদ্দুর লাগলে সমস্যা বেড়ে যায়

• ৫০% ক্ষেত্রে এসএলই থাকলে রক্তাল্পতার ঝুঁকি বাড়ে

• অণুচক্রিকা কমে যেতে পারে

• লুপাস হলে ধমনিতে প্লেক অর্থাৎ চর্বির স্তর জমে যায়। এর ফলে হার্ট অ্যাটাক ও ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে

• হার্টের বিভিন্ন সমস্যা যেমন পেরিকার্ডাইটিস, মায়োকার্ডাইটিস ও এন্ডোকার্ডাইটিসের আশঙ্কা বাড়ে

• ফুসফুসের আবরণ প্লুরাতে প্রদাহের ফলে প্লুরাইটিস হতে পারে

• পেনলেস হিমাচুরিয়া অর্থাৎ প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বের হয় কোনো ব্যথা বেদনা ছাড়াই

• কিডনির কাজ এলোমেলো হয়ে কিডনি থেকে প্রোটিন বেরিয়ে যেতে পারে

তাই এ রকম কোনো উপসর্গ দেখলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করিয়ে নেয়া উচিত।

১৫ – ৩৫ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি বেশি। ঋতু চলাকালীন লুপাসের উপসর্গ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। দেখা গেছে যে গর্ভনিরোধক ওষুধ খেলে এবং মেনোপজের পরে ইস্ট্রোজেন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করালে এসএলইর উপসর্গ আরো অনেক বেড়ে যায়। তাই ধারণা করা হয় যে স্ত্রী হরমোন ইস্ট্রোজেন প্রোজেস্টেরনের সঙ্গে এই অসুখের একটা সম্পর্ক আছে। আধুনিক মেডিক্যাল সায়েন্সের কল্যাণে সঠিক চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার মান বদল করে আর পাঁচজন মানুষের মতো দীর্ঘায়ু পেতে পারেন এই রোগী। প্রয়োজন সচেতনতা, ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × 3 =

Back to top button