মানবজাতির মুক্তির ও সর্বোত্তম উন্নতির দিশারী মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ)
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাতের পুণ্য স্মৃতিময় দিন আজ ১২ রবিউল আউয়াল। সৌদি আরবের মক্কা নগরে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের একই দিনে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। বাংলাদেশে দিনটি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) নামে পরিচিত।
সমগ্র বিশ্বে মুসলমানদের কাছে ১২ রবিউল আউয়াল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। মুসলমান সম্প্রদায় দিনটিকে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী হিসেবে পালন করে। আরব জাহান যখন পৌত্তলিকতার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল, তখন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন মহান আল্লাহ।
বিশ্বনবী ছিলেন শান্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও ইসলামী ঐক্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার। তিনি ছিলেন ‘মানবজাতির মুক্তি ও সর্বোত্তম উন্নয়নের দিশারী। মানবজাতির নৈতিক উন্নয়নসহ সার্বিক উন্নয়নকে পরিপূর্ণতা দিতেই ঘটেছিল তাঁর আবির্ভাব।
মহানবীর আবির্ভাব ঘটেছিল মানব জাতির এক চরম দুঃসময়ে যখন বিশ্বজুড়ে বিরাজ করছিল হানাহানি, জাতিগত সংঘাত, কুসংস্কার, অনাচার এবং জুলুম ও বৈষম্যের দৌরাত্ম্য। নারী জাতির ছিল না কোনো সম্মান। শির্ক ও কুফরির অন্ধকারে গোটা পৃথিবী ছিল আচ্ছন্ন। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.) তাঁর শুভ জন্মের ৪০ বছর পর নবুওতি মিশন তথা ইসলামের বৈপ্লবিক নানা বাণী নিয়ে অজ্ঞ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং সব ধরনের উন্নত নৈতিক গুণ-বিবর্জিত মূর্তি পূজারী বর্বর আরব জাতির মধ্যে এমন পরিবর্তন সৃষ্টি করেন যে তারা মানব জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নৈতিকতাসহ নানা ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নত সভ্যতা উপহার দিতে সক্ষম হয়।
বিশ্বনবী (সা)’র বহু মু’জিজার মধ্যে সবচেয়ে বড় মু’জিজা হল, অসভ্য ও বর্বর আরব জাতির চরিত্রকে বিস্ময়করভাবে বদলে দেয়া। বিশ্বনবী (সা)’র আহ্বানে এক আল্লাহতে বিশ্বাসী তথা মুসলমান হওয়ার আগে কেমন ছিল আরবরা? আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ)’র বর্ণনাসহ নানা নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী, মহানবীর নেতৃত্বে মুসলিম সমাজ গঠনের আগে আরব দেশে রক্তপাত ও যুদ্ধ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সে যুগে আরবরা এমন কোনো অনাচার নেই যা তারা করত না। তারা নিজেরা নানা মূর্তি বানিয়ে সেইসব মূর্তির পূজা করত। আরবদের বেশিরভাগই তখন জীবিকা নির্বাহ করতে চুরি-ডাকাতি ও লুটপাটের মাধ্যমে।
আরবদের মধ্যে ব্যভিচার ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। আরবদের কেউ কেউ তখন কন্যা শিশু হওয়াকে লজ্জাজনক বলে মনে করত এবং কন্যা শিশুকে জীবন্ত কবর দিত। যারা নিজ সন্তানের সঙ্গে এমন নৃশংস আচরণ করতে পারত তারা অন্য পরিবার, প্রতিবেশী ও অন্য গোত্রের সঙ্গে কেমন আচরণ করত তা সহজেই অনুমেয়।
বিশ্বনবী (সা) তাঁর শ্রেষ্ঠ চরিত্র ও রিসালাতের আহ্বানের মাধ্যমে আরব জাতির মধ্যে আনেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এক সময়কার বর্বর আরবরাই মুসলমান হওয়ার পর যুদ্ধক্ষেত্রে জখম হয়ে চরম পিপাসায় যখন মৃত্যুর সম্মুখীন হত তখন কেউ তাদের পানি দিতে চাইলে সে বলত: আমার অমুক আহত ভাই সম্ভবত আরো বেশি তৃষ্ণার্ত, তাকে আগে দিন! অন্য আহত আরব মুসলমানও বলতেন একই কথা!
আর এ ধরনের ইসলামী বৈশিষ্ট্যের কারণেই এক সময় মুসলিম উম্মাহ বিশ্বকে উপহার দিয়েছিল মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সভ্যতা। জ্ঞান-অর্জনের প্রতি ইসলাম ও মহানবীর অশেষ গুরুত্ব আরোপের কারণে বহু জ্ঞানী- গুণী, বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, দার্শনিক ও মহামনীষী উপহার দিতে সক্ষম হয় মুসলমানরা।
কিন্তু গত কয়েক শ বছরে মুসলমানরা নানা দুর্বলতার কারণে এবং বিশেষ করে ইসলামের শিক্ষাকে জীবনের সবক্ষেত্রে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি বলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রসহ নানা ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। গোটা মুসলিম জাহানের বেশির ভাগ অঞ্চলই শিকার হয় পশ্চিমা উপনিবেশবাদের। ফলে ইসলাম আজও বিশ্বের ওপর তার প্রত্যাশিত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কিন্তু মুসলমানরা যদি আজো ইসলাম ও কুরআনের আসল শিক্ষার পথে ফিরে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালায় তাহলে তারা সব অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা থেকে মুক্ত হয়ে আবারো সব দিকে কর্তৃত্বশালী হতে পারবে এবং গোটা মানবতাই পাবে প্রত্যাশিত সার্বিক মুক্তি ও অপার কল্যাণ।
পবিত্র কুরআনে মুসলমানদের বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহর রজ্জু শক্ত করে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। কিন্তু মুসলমানরা এক আল্লাহ, এক নবী, অভিন্ন কুরআন ও ইসলামের মূল নীতিগুলো মেনে নেয়া পরস্পরের মধ্যে সীসা ঢালা প্রাচীরের মত ঐক্য গড়ে তুলতে পারছে না। অথচ মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান, ইহুদি ও অন্য অমুসলিমদের সুদৃঢ় ঐক্য লক্ষ্যণীয়।
বিশ্বনবী (সা.) যে সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন সেখানে ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা জাতিগত পার্থক্যের কারণে কারো অধিকার বেশি বা কম ছিল না। বরং খোদাভীরুতাকেই ধরা হত শ্রেষ্ঠত্বের বা মর্যাদার মানদণ্ড। একজন নিঃস্ব কালো বর্ণের ক্রীতদাসও পেত অন্য যে কোনো মুসলমানের মত স্বাভাবিক মর্যাদা এবং খোদাভীরুতার মত যোগ্যতার বলে সে সেনাপতি বা মুয়াজ্জিন হওয়ার মত উচ্চ পদেরও অধিকারী হত। আর এগুলোই হল সব ধরনের ঐক্যের মহাসূত্র যার বাস্তবায়ন আজো মুসলিম সমাজের জন্য অপরিহার্য ও একান্তই জরুরি বিষয়।
পবিত্র কুরআন বলেছে, মুসলমানরা পরস্পরের ভাই। ইসলাম দু-জন মুসলমানের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে দেয়া এবং তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব জোরদারকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। মহানবী (সা.) তাঁর সহনশীলতা, উদারতা ও ক্ষমাশীলতার মাধ্যমে বহু গোত্র এবং বিবদমান মুসলমানদের মধ্যে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ফেতনাবাজদের কঠোর হাতে দমন করার শিক্ষাও দিয়ে গেছেন।
পবিত্র কুরআন বলেছে, মুহাম্মাদের প্রকৃত সঙ্গী বা অনুসারীরা পরস্পরের প্রতি দয়ার্দ্র এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর। মুসলিম নেতাদের বেশিরভাগই আজ ইসলামের চেয়েও জাতীয়তাবাদকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাদের অনেকেই মনে করেন পশ্চিমা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই ইসলাম কায়েম করা সম্ভব! অধিকাংশের ঐক্যমত্যের নামে অনেক অদূরদর্শী ও ভুল পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যা ছিল পবিত্র কুরআন এবং হাদিসের শিক্ষার সুস্পষ্ট বিপরীত। ইসলামের সবচেয়ে নির্ভুল ব্যাখ্যাদাতা তথা বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের অনেক সদস্য তথা পবিত্র ইমামদেরকে কোণঠাসা করে বা গোপনে হত্যা করে ইসলামের আলোকে চিরতরে নিভিয়ে দিতে চেয়েছে খলিফা নামধারী একদল রাজা-বাদশাহ।
আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রসহ অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রয়েছে মুসলমানরা। এর কারণ হল পশ্চিমাদের অন্ধ আনুগত্য বা অনুকরণ এবং ইসলামী আদর্শ ও জিহাদ থেকে দূরে থাকা। তাই মুসলিম দেশগুলোর শাসকরা ও বুদ্ধিজীবীরা এখনও পশ্চিমা শোষক ও উপনবিশেবাদীদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন।
ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, কাশ্মির ও মিয়ানামারের মজলুম মানুষের জন্য তারা কার্যকর ও ঐক্যবদ্ধ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। বিশ্বনবী (সা.) মিটিয়ে দিয়েছিলেন জাতিগত গরিমা বা বংশীয় ভেদাভেদের সীমারেখা। আজো কেবল ইসলামের ধর্মীয় বন্ধনই পৃথিবীর দুই প্রান্তে অবস্থিত বা দূরতম অঞ্চলে অবস্থিত মুসলমানের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির একমাত্র কার্যকর বন্ধন। একমাত্র ভ্রাতৃত্বের চেতনার কারণেই নানা অঞ্চলের এবং নানা ভাষা ও জাতিগত পরিচিতির অধিকারী মুসলমানরা পরস্পরের সুখ ও দুঃখে প্রভাবিত হয়। ইসলামী আদর্শই যদি হয় মুসলমানদের ঐক্যের মূল সূত্র তাহলে তাদের কখনও হতাশ হওয়া উচিত হবে না। মুসলমানদেরকে ফিরে যেতে হবে প্রতিরোধ, ঐক্য ও আত্মত্যাগের সংস্কৃতির দিকে। কবি নজরুলের ভাষায় শহীদী ঈদগাহে যখন হবে জমায়েত ভারি তখনই সারা দুনিয়ায় আবারও হবে ইসলামী ফরমান জারি।