BreakingLead Newsজাতীয়

অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল আচরণে গণমাধ্যম ভূমিকা রাখে: আদালতের অভিমত

দণ্ডবিধি এবং অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে করা মামলায় প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে পাসপোর্ট জমা দেওয়ার শর্তে জামিন দিয়েছেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ভার্চুয়ালি দুপক্ষের বক্তব্য শুনে আজ রোববার সকাল পৌনে ১১ টার দিকে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বাকী বিল্লাহ এ আদেশ দেন। এখন অপেক্ষা মুক্তির।

আদেশে আদালত বলেন, আসামির জামিন পাঁচ হাজার টাকা বন্ডে (মুচলেকা) মঞ্জুর করা হলো। আসামিকে তার পাসপোর্ট আদালতে দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হলো।

আদালত আরও বলেন, গণমাধ্যম গণতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ। গণমাধ্যমের কারণেই কিন্তু অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল আচরণ করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সুতরাং কোর্ট এবং গণমাধ্যম কখনোই একটি আরেকটির জন্য বাধা হিসেবে কাজ করে না। কোর্ট সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। সুতরাং আমরা আশা করব যে, উনি (রোজিনা ইসলাম) ওনার দায়িত্ব পালনে আরও সচেতন থাকবেন।

সাত দিনের পরিক্রমা
পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ১৭ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টার আটকে রেখে হেনস্তা ও নির্যাতন করা হয়। রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁকে শাহবাগ থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাত পৌনে ১২টার দিকে তাঁর বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়। মামলার বাদী হন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী।

এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১৮ মে রোজিনা ইসলামকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়েছিল। পুলিশ তাঁকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে। রোজিনার আইনজীবীরা তাঁর জামিন চান। আদালত রিমান্ডের আবেদন নাকচ করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আর জামিন আবেদনের ওপর অধিকতর শুনানির জন্য ২০ মে দিন রাখেন। এই আদেশের পর রোজিনা ইসলামকে কাশিমপুর মহিলা কারাগারে পাঠানো হয়।

শুনানি নিয়ে ১৮ মে আদালত রিমান্ড আবেদন নাকচ করে দিয়ে রোজিনা ইসলামকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। সেই সঙ্গে জামিন আবেদনের ওপর অধিকতর শুনানির জন্য ২০ মে শুনানির দিন রাখেন। এই আদেশের পর সেদিন রোজিনা ইসলামকে কাশিমপুর মহিলা কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর অর্থাৎ ১৮ মে থেকে রোজিনা ইসলাম কারাগারে আছেন।

আগের ধারাবাহিকতায় ২০ মে রোজিনা ইসলামের জামিন আবেদনের ওপর প্রায় ঘণ্টাব্যাপী ভার্চুয়ালি শুনানি হয়। দুপক্ষের শুনানি নিয়ে সেদিন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বাকী বিল্লাহ রাষ্ট্রপক্ষের নথি উপস্থাপন ও আদেশের জন্য ২৩ মে দিন রাখেন। এর ধারাবাহিকতায় আজ সাড়ে দশটায় ভার্চুয়ালি শুনানি ও আদেশ হয়। এর আগে ১৯ মে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে করা ওই মামলাটির তদন্তভার পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়।

প্রায় আট মিনিটে শুনানি ও আদেশ
কার্যক্রম শুরু হলে সকাল দশটা ৩৫ মিনিটে ভার্চুয়ালি আদালতে যুক্ত হন রোজিনা ইসলামের আইনজীবীরা ও রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানির শুরুতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু বলেন, মামলাটি আদেশের জন্য আছে। আগের তারিখে বলা হয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কিছু ডকুমেন্ট উপস্থাপন করা হবে ও রোববার আদেশ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা কিছু তথ্য দিয়েছেন। মামলাটি স্পর্শকাতর ও আসামি মহিলা।

যদি সে (রোজিনা) আদালতে তার পাসপোর্ট দাখিল করে এবং যেন বিদেশে যেতে না পারে—সেই শর্তে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়া যেতে পারে। এতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। আসামি রোজিনা ইসলামের পাসপোর্ট যদি আদালতে দাখিল করে, সেই শর্তে সাময়িকভাবে সে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেতে পারেন।

রোজিনা ইসলামের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে যে ডকুমেন্ট দাখিল করেছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই। পাবলিক প্রসিকিউটর পাসপোর্ট জমা দেওয়ার শর্তে জামিনের কথা বলেছেন। আইনের দৃষ্টিতে শর্তসাপেক্ষে জামিন কোনো জামিন নয়। তদুপরি আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আদালতের নিবেদন পাবলিক প্রসিকিউটর যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেই প্রস্তাবে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই। সুতরাং উভয় পক্ষের বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে আদালত আদেশ প্রদান করবেন, বলেন এহসানুল হক সমাজী।

এ সময় রোজিনা ইসলামের পক্ষে আইনজীবী আমিনুল গনি টিটো, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও প্রশান্ত কুমার কর্মকার শুনানিতে ছিলেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মো. হেমায়েত উদ্দিন খান। এর আগে রোজিনা ইসলামের পক্ষে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবী আব্দুর রশীদ শুনানিতে অংশ নেন। এ ছাড়া রোজিনার পক্ষে আইনি সহায়তা দেন, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইনজীবী মশিউর রহমান, মহিলা পরিষদের দিপ্তী সিকদার, শাম্মী আক্তার। এ ছাড়া আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন সুমন কুমার রায়, মাহবুবুল হক, আবদুর রহীম।

শুনানিতে জামিনের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি
রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় এবং অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।

এর আগে গত ২০ মে জামিন শুনানিতে রোজিনা ইসলামের আইনজীবীরা বলেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন, সৃজিত ও উদ্দেশ্যমূলক। জামিন পাওয়ার অধিকার তিনি সংরক্ষণ করেন। এটা তাঁর প্রাপ্য। তবে মামলার ধারাগুলো জামিন-অযোগ্য বলে দাবি করে সরকারি কৌঁসুলি শুনানিতে বলেছেন, স্পর্শকাতর বিষয়ে তথ্য চুরি করে রোজিনা ইসলাম নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন, যা অপরাধ।

মামলায় উল্লেখিত দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারা ও অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারার প্রসঙ্গ টেনে শুনানিতে রোজিনা ইসলামের আইনজীবীরা বলেন, এজাহারে চুরির কথা বলা হয়েছে। যদি কেউ বলে, আসামি ডকুমেন্ট বা প্রোপার্টি চুরি করেছে, তাহলে অবশ্যই এর বর্ণনা থাকতে হবে। কিন্তু এজাহারের কোথাও সেই বর্ণনা নেই। জব্দতালিকায় দেখা যায়, কথিতমতে ডকুমেন্টস কিংবা মোবাইল ফোনসহ যা কিছুই থাকুক না কেন, তা রোজিনা ইসলামের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়নি।

অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ধারা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ এবং ৫ ধারা হচ্ছে শত্রুভাবাপন্ন কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ বা তথ্য হস্তান্তর। কিন্তু এই মামলার এজাহারে এই দুই ধারার কোনো উপাদান নেই। এ আইনের ১২ ধারা অনুসারে, যদি ৩ ধারার কোনো অপরাধ না হয়ে থাকে, তাহলে বাকি ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য। সুতরাং ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬ ধারা অনুযায়ী জামিনযোগ্য ধারা হওয়ায় রোজিনা ইসলামের জামিনে মুক্তি পাওয়ার আইনত অধিকার আছে।

জামিনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে রোজিনা ইসলামের আইনজীবীরা বলেন, রোজিনা একজন নারী, মা এবং অসুস্থ। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী একজন নারী জামিন পাওয়ার অধিকারী। তিনি অসুস্থ, এজাহারে কথিতমতে কোনো ডকুমেন্ট চুরির বর্ণনাও নেই, এমনকি তা তাঁর কাছ থেকে উদ্ধারও হয়নি; গুপ্তচরবৃত্তির কোনো অভিযোগ নেই, কোনো রংফুল কমিউনিকেশনের অভিযোগও নেই; তাই তিনি জামিন পাওয়ার যোগ্য।

অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শুনানিতে বলেছিলেন, তিনি বিদেশ থেকে টিকা আনার জন্য মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্তের অনুলিপি ও গোপনীয় নথি নিয়ে লুকিয়ে রাখেন। সেখানকার কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই তিনি এসব নেন ও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

মামলার সব ধারা জামিন-অযোগ্য। অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারায় শাস্তি ১৪ থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড। তাই এই মামলার বিচার হবে জজ আদালতে। রোজিনা ইসলাম ঘটনাস্থলে একটি স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। সেই ভিডিও টেপটি আদালতের কাছে দাখিল করা হবে। জামিন আবেদনকারী মহিলা হলে কী হবে, তিনি যে কাজটি করেছেন, তা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন।

শুনানিতে রোজিনা ইসলামের আইনজীবী বলেন, সচিবালয়ে গিয়েছিলেন তথ্য সংগ্রহ করতে। যে কারণে আপামর জনসাধারণ রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। রোজিনা ইসলাম কোনো অজামিনযোগ্য অপরাধ করেননি। তাই রাষ্ট্রপক্ষের আমদানি করা তথ্যের ভিত্তিতে জামিন নামঞ্জুর করার কোনো সুযোগ নেই।

সপ্তাহ জুড়ে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ
এ দিকে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের মুক্তি দাবিতে গত সাত দিন ধরেই প্রতিবাদ ও আন্দোলন চলেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রতিবাদ হয়েছে। গত ১৭ মে রাত থেকেই তাঁর মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে। আজ রোববারও সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন করছেন। জামিন হলেও মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে তারা।

জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) ও বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএইচআরএফ)সহ সাংবাদিকদের বিটভিত্তিক সংগঠন, সারা দেশের সাংবাদিকের বিভিন্ন সংগঠন, ইউনিয়ন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক ও সামাজিক সংগঠন রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে।

সূত্রঃ প্রথমআলো

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 − seven =

Back to top button