এক সময় কলকাতা থেকে মানুষ বাসে চড়ে লন্ডন যেত!
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় খুব সহজেই সড়ক পথে যাতায়াত করা যায়। তবুও সময় বেশি লাগায় সড়ক পথে কলকাতা যাওয়ার ঝক্কি পোহাতে চায় না অনেকেই। দূর দেশে যেতে অনেকে তাই তো আকাশপথই বেছে নেন।
কখনো কি ভেবে দেখেছেন বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে যাবেন তাও আবার বাসে চড়ে সড়কপথে। ভাবতেই কেমন অসহ্য মনে হচ্ছে না! এতো সময় বাসে বসে থাকা তো আর সহজ কথা নয়।
তবে জানেন কি? এক সময় কলকাতা থেকে মানুষ লন্ডনে যেত তাও আবার বাসে চড়ে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য লন্ডন থেকে কলকাতা পর্যন্ত বাস সার্ভিস ছিল। যা বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ বাস রুট বলে বিবেচিত।
ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন থেকে ভারতের কলকাতা পর্যন্ত এই বাসটি ২০ হাজার ৩০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করত। সম্প্রতি লন্ডনের ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনের ১৯৬০ এর দশকের ছবি অনলাইনে ভাইরাল হয়েছে। ছবিটি বিশ্বের দীর্ঘতম এই রুটের যাত্রীরা বাসে উঠার পূর্বে ক্যামেরাবন্দি করা হয়।
১৯৬০ এর দশকে বিশ্বের দীর্ঘতম এই রুটে বাস চলাচল শুরু হয়েছিল। তৎকালীন সময়ের ১১টি দেশের মধ্য দিয়ে বাসটি চলাচল করত। এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা বাসটির নাম ছিল ‘আলবার্ট’। এটি একটি বিলাসবহুল ডাবল ডেকার ছিল।
১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ১৫ বার লন্ডন থেকে কলকাতা যাতায়াত করেছিল বাসটি। আর লন্ডন থেকে কলকাতা হয়ে আস্ট্রেলিয়ার সিডনি পর্যন্ত যাতায়াত করেছিল চার বার। কলকাতা থেকে লন্ডন পর্যন্ত যাওয়ার জন্য ভাড়া ছিল ৮৫ পাউন্ড। ভারতীয় মুদ্রায় সাত হাজার ৮৮৯ রুপির সমান ছিল। যা বাস যাত্রার ক্ষেত্রে খুবই ব্যয় বহুল ছিল।
আলবার্ট ১৯৪৭ সালে নির্মিত একটি এলবিন ডাবল ডেকার বাস। এর পূর্বের নম্বর ছিল ২০০৪ সিডনি। ২১ বছর যাত্রী সেবা দেয়ার পর একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে যায় আলবার্ট। পরবর্তী সময় এটি মেরামত করে একটি বিলাসবহুল বাসে রূপান্তর করা হয়।
ব্রিটিশ পর্যটক অ্যান্ডি স্টুয়ার্ট ১৯৬৮ সালের মে মাসে বাসটি ক্রয় করেন। এরপর তিনি এটি নিজের ভ্রাম্যমাণ বাড়ি ও গাড়ি হিসেবে গড়ে তোলেন। কারণ তিনি বাসটিতে পর্যাপ্ত সুবিধা রেখেছিলেন যাত্রী ও নিজের জন্যও। স্টুয়ার্ট এরপর একটি অভিনব পরিকল্পনা করেন। তিনি বাসে চড়ে আস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে লন্ডনে নিজ বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।
এই দীর্ঘ পথ তিনি একাকী না গিয়ে সঙ্গে কয়েকজন যাত্রী নেয়ার ব্যবস্থা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ১৩ জন যাত্রী নিয়ে সিডনি থেকে রওনা দিয়ে ভারত হয়ে লন্ডনে পৌঁছান। এই যাত্রায় তিনি ১৬ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছিলেন। এর প্রথম যাত্রা শুরু হয় সিডনির মার্টিন প্যালেসের জিপিও থেকে ১৯৬৮ সালের ৮ অক্টোবর। দিনটি ছিল বুধবার।
১৩২ দিনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাসটি লন্ডন পৌঁছায়। এরপর বাসটি আরো ১৪ বার এই দীর্ঘতম রুটে যাত্রা করে। এমনকি লন্ডন, কলকাতা এবং সিডনির মধ্যে আলবার্ট ট্যুর নামের একটি নিয়মিত বাস পরিষেবার সময়সূচি তৈরি করা হয়েছিল।
আলবার্ট বাসটি লন্ডন থেকে যাত্রা শুরু করে বেলজিয়াম, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, যুগোশ্লোভিয়া, বুলগেরিয়া, তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে অমৃতসর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করত। ভারতের দিল্লি, আগ্রা, বেনারসে থেমে কলকাতা পৌঁছাত। ভারত থেকে বার্মা, থাইল্যান্ড মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরের মধ্য দিয়ে জাহাজ কিংবা ফেরিতে পার হয়ে অস্ট্রেলিয়ার পথে প্রবেশ করত।
এরপর সিডনিতে পৌঁছাত। বাসটির একটি শিডিউল অনুযায়ী, লন্ডন থেকে ১৯৭২ সালের ২৫ জুলাই যাত্রা শুরু করে ১৯৭২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কলকাতায় পৌঁছায়। এ যাত্রায় মাত্র ৪৯ দিন সময় লেগেছিল। যা সত্যিই বিস্ময়কর।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে বাসের যাত্রীরা বিরক্ত হত না কারণ সেখানে সময় কাটানোর বেশ ভালো ব্যবস্থা ছিল। ডাবল ডেকার বাসের নিচের ডেকে খাওয়ার জায়গা এবং পড়ার জায়গা ছিল। একাকী ঘুমানোর জন্যও ছিল পৃথক স্লিপিং বাঙ্ক। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় বাসের ভিতর গরম রাখার জন্য হিটার ছিল।
এককথায় বাসটিতে অনেকটা বাড়ির মতো অনেক সুবিধা ছিল। আলবার্ট যাত্রা পথে ১৫০ টিরও বেশি সীমান্ত অতিক্রম করত। তবে কখনো কোনো জটিলতায় পড়তে হয়নি তাকে। কখনো চেকিং বা নজরদারিও কারা হয়নি বলে জানা যায়। সন্দেহও করা হয়নি তার বাসে থাকা যাত্রীদের।
আলবার্ট যেসব দেশ পেরিয়ে আসত, সবার কাছে সে বন্ধু-দূত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ১৯৭৬ সালে ইরানে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি এবং অবরুদ্ধ হলে বাস সার্ভিসটি বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় পর ২০১২ সালে বাসটি অস্ট্রেলিয়ায় ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। তবে তখন আর ব্যবহার উপযোগী ছিল না।