কম্পিউটার, মোবাইলের আলো থেকে চোখ ভালো রাখার উপায়
প্রযুক্তিনির্ভর যুগে সারাদিন বিভিন্ন কাজের জন্য চোখ রাখতে হয় কম্পিউটার ও মোবাইলে। ফলে চোখের ওপর অনেক চাপ পড়ে। তার উপর করোনাকালে লকডাউনের কবলে পড়ে গেম খেলা, ভিডিও দেখা, অফিসের কাজ, অনলাইন মিটিং, আত্নীয়-স্বজনের সংগে আলাপ সবই এখন মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে হয়। কম্পিউটার ও মোবাইল প্রতিনিয়ত ব্যবহার করলে অবশ্যই চোখের যত্ন নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কম্পিউটার স্ক্রিন এবং মোবাইল থেকে চোখ রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দীর্ঘ সময় স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে চোখ লাল হয়ে পানি পড়ে, চোখে আর ঘাড়ে ব্যথার সংগে চোখে চুলকানি ও চোখ জ্বালাপোড়া ভাব থাকে। এছাড়া মাথা ব্যথা, চোখ ব্যথা, চোখে ক্লান্তি বোধ করা, ঝাপসা দেখা বা মাঝেমধ্যে দুটি দেখা, কাঁধে ব্যথা থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সমস্যার নাম ‘সিভিএস’ অর্থাৎ কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম।
অন্ধকারে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, পিসি বা টিভি ব্যবহার করলে এর নীল আলো সরাসরি চোখের ওপর পড়তে থাকে। ফলে রেটিনার কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা মোবাইল থেকে বের হওয়া নীল রশ্মির কারণে চোখে শুষ্কতা দেখা দেয়।
আসুন জেনে নিই কীভাবে চোখের যত্ন নেবেন:
১. যাঁরা কম্পিউটারে কাজ করেন তাঁদের প্রতিবছর অন্তত একবার চোখ পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
২. কম্পিউটার স্ক্রিনে পড়ার জন্য খুব ছোট ফন্ট ব্যবহার করবেন না। চোখের কষ্ট হয় এমন ফন্ট বাদ দিয়ে চোখের জন্য আরামদায়ক ফন্ট নির্বাচন করুন।
৩. কম্পিউটার স্ক্রিনের কারণে আমরা চোখের পলক ফেলতে ভুলে যাই। কম্পিউটারে কাজের সময় নিয়মিত বিরতিতে চোখের পলক ফেললে চোখে ময়েশ্চার তৈরি হয় যা চোখের শুষ্কতা দূর করে।
৪. চোখ সুরক্ষার জন্য একটি নিয়ম হচ্ছে ২০-২০-২০। এতে প্রতি ২০ মিনিট পর পর, ২০ ফুট দূরত্বের কোনো জিনিসের দিকে ২০ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকতে হয়। কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকা ক্লান্ত চোখ বা কোনো কাজ করার সময় দৃষ্টি সরানোর সুযোগ না পেলে এই নিয়ম মেনে চলা উচিত। এতে চোখে যথেষ্ট আর্দ্রতা থাকে এবং চোখের ওপর চাপ কমে।
৫. পিসিতে একটানা দীর্ঘক্ষণ কাজ করবেন না। বিশেষ করে একটানা দুই ঘণ্টার বেশি টিভি দেখা, কম্পিউটারে কাজ করা বা সেলফোনে নজর রাখা উচিত নয়। কাজের মধ্যে কয়েক মিনিটের জন্য বিরতি দিন। এক ঘণ্টা কম্পিউটারে কাজ করে ৫-১০ মিনিটের বিরতি দিয়ে অন্য কোনো দিকে দেখুন বা অন্য কোনো কাজে সময় কাটিয়ে আবার কম্পিউটারের কাজ শুরু করতে পারেন। ভালো হয়, জানালার বাইরে সবুজ দৃশ্য দেখা বা কিছুক্ষণ পায়চারি করে এসে আবার কাজ শুরু করা।
৬. কম্পিউটার মনিটরের অ্যান্টি গ্লেয়ার স্ক্রিন ব্যবহার করতে পারেন। ঘরের আলোর সংগে সামঞ্জস্য বজায় রেখে কম্পিউটার মনিটরের আলো কমানো বা বাড়ানো যেতে পারে। এতে মনিটরের লেখাগুলো দেখতে বা পড়তে আরামদায়ক হয়। শুধু কম্পিউটারই নয়, মোবাইল, ট্যাবলেট বা আই প্যাড ব্যবহার করেও একই সমস্যা দেখা যায়। তাই কম্পিউটার ও মোবাইলের স্ক্রিন যেন অতিরিক্ত উজ্জ্বল না হয় সেজন্য আলো কমিয়ে রাখুন।
৭. মনিটর জানালা থেকে দূরে থাকা উচিত। জানালার দিকে মুখোমুখি বসে কম্পিউটার চালানো থেকেও বিরত থাকতে হবে। চশমা পরে কাজ করলে অ্যান্টিগ্লেয়ার লেন্স ব্যবহার করলে ভালো হয়। যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য কম্পিউটারের স্ক্রিন বা মোবাইলের সামনে বসে থাকতে হয় তাহলে এমন লেন্স ব্যবহার করা উচিত যেগুলি নীল রশ্মি দূর করতে সক্ষম। এর জন্য অ্যান্টি গ্লেয়ার গ্লাস বা ব্লু কাট লেন্স একটি ভালো বিকল্প। যার কারণে সরাসরি আলো চোখের উপর পড়ার পরিবর্তে এটি কেটে যায় এবং ছেড়ে যায়।
৮. কাজের ফাঁকে কিছু হালকা চোখের ব্যায়াম করতে পারেন। চোখের মণি উপরে নিচে আর পাশে ধীরে ধীরে রোল করার মতো করে ঘোরান। চোখ আরাম পাবে।
৯. মাঝে মাঝে চোখে পানির ঝাপটা দিন। সারাদিনে ১০ থেকে ১৫ বার চোখে পানির ঝাপটা দিন। তাতে চোখ ঠাণ্ডা থাকে। চোখ আর্দ্র হয় ও রক্তসঞ্চালন বাড়ে। তবে একদম ঠাণ্ডা বা মাত্রাতিরিক্ত গরম পানি দেবেন না চোখে।
১০. কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে মোটামুটি ২৫ থেকে ২৬ ইঞ্চি—বা কমপক্ষে এক হাত পরিমাণ দূরত্বে চোখ রাখুন। স্ক্রিন যেন চোখের ঠিক সমান জায়গায় থাকে। স্ক্রিনের রং (কালার-কন্ট্রাস্ট) এবং আলো মাঝারি অবস্থানে রাখুন, যাতে খুব অন্ধকার বা খুব বেশি আলো না হয়। চোখ থেকে দূরে রেখে মোবাইল ব্যবহার করুন। চেষ্টা করুন ১২-১৫ ইঞ্চি দূরত্বে রেখে ব্যবহার করতে।
১১. পিসি বা ল্যাপটপের স্ক্রিনটি নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন। কেননা স্ক্রিনে পড়া ধুলা, ময়লা বা অন্য দাগওয়ালা স্ক্রিন দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ‘ক্রনিক হেডেক’ দেখা দিতে পারে।
১২. পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। সারাদিনের কাজের পর অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুম জরুরি। খেয়াল রাখুন রাতে ঘুমের আধঘণ্টা আগে ফোন বা ল্যাপটপ বন্ধ করে দিন। ওদিকে আর দেখবেন না।
১৩. চোখ ভালো রাখতে গাজরের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাক-সবজি, বাদাম, কমলালেবু খান। টাটকা শাক-সবজিতে থাকে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি। যা চোখের কর্নিয়া ভালো রাখতে সাহায্য করে।
চোখের কিছু ব্যায়াম:
১. চোখ ওপরে-নিচে এবং ডান পাশ থেকে বাঁ পাশে ঘোরান। এরপর ধীরে ধীরে ‘৪’-এর মতো করে চোখ ঘোরান।
২. চোখ নমনীয় করতে বুড়ো আঙুল চোখের সামনে ধরুন এবং আঙুলের দিকে দৃষ্টি দিন। এরপর চোখের দৃষ্টি সরিয়ে অন্তত ২০ পা দূরে আছে এমন কোনো বস্তুর দিকে তাকান। একসংগে কাছের এবং দূরের বস্তুর দিকে এভাবে তাকালে চোখে শক্তির সঞ্চার হয়। এই ব্যায়াম ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত করলে চোখের ঝাপসা ভাবের অনুভূতিও দূর হবে।
৩. দুই হাতের তালুর মাঝে কিছুক্ষণ চোখ ঢেকে রেখে ধীরে ধীরে শ্বাস নিন এবং চোখের পেশিগুলোকে শিথিল করুন।
৪. ঘাড় ও পিঠ হাত দিয়ে হালকা ম্যাসাজ করুন। এতে চোখ প্রশান্তি পাবে।
৫. কাজের ফাঁকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত-পা ও কাঁধ নাড়াচাড়া করলে বা ব্যায়াম করলে চোখ, ঘাড়, কাঁধ, কোমর ব্যথার উপসর্গগুলো থেকে মুক্ত থাকা যায়।