করোনাভাইরাসবিবিধ

গাইবান্ধার প্রথম রোগী কীভাবে করোনা জয় করলেন

গাইবান্ধার প্রথম করোনা শনাক্ত রোগী আমেরিকা প্রবাসী মা ও ছেলে সম্প্রতি সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। তারা জানিয়েছেন, চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক সাপোর্ট তাদের মনোবল বাড়িয়েছে, দ্রুত সুস্থ করে তুলেছে|

সৌরভ সরকার (২২) ও তার মা প্রতিমা সরকার (৪৯) গত ১০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক প্রবাসী। নিউইয়র্কের ইউনিভার্সিটিতে সৌরভ পড়াশুনা করছেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে।

বোনের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ৯ মার্চ ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় আসেন প্রতিমা সরকার। পরদিন তারা গাইবান্ধায় পৌঁছান। ১১ মার্চ সাদুল্লাপুরে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ১৬ তারিখ পর্যন্ত তারা সাদুল্লাপুর ও সুন্দরগঞ্জে (বরের) বাড়িতে অবস্থান করেন|

সৌরভ জানান, ‘মার্চের ১৫ থেকে ১৬ তারিখে আমার গায়ে ১০০ ডিগ্রির ওপরে জ্বর ছিল, ১৬ তারিখ একটু সর্দিও লাগে| এ সময় জ্বরের জন্য আমরা প্যারাসিটামল খাই| ১৭ তারিখ আমার একটু কাশিও শুরু হয় তবে পরদিন কাশি বন্ধ হয়ে যায়| ২০ তারিখ থেকে আমার সব উপসর্গ বন্ধ হয়ে যায়।’

প্রতিমা সরকার জানান, ‘ ১৮ মার্চ জ্বর আসে এবং তা ১০২ ডিগ্রির ওপরে ছিল।  আমিও প্যারাসিটামল খাওয়া শুরু করি| ২০ তারিখ আইইডিসিআর থেকে লোক এসে আমাদের নমুনা নিয়ে যায়| ২৩ তারিখ যখন আমি জানতে পারি যে আমাদের করোনা শনাক্ত হয়েছে, তখন খুব ভয় পেয়ে যাই কিন্তু মনোবল হারাইনি।’

সৌরভ বলেন, ‘করোনা শনাক্তের পর ২৭ মার্চ পিপিই পরিহিত ডাক্তাররা আমাদের হাসপাতালের একটি আলাদা বিল্ডিং-এ আলাদা রুমে রাখা হয়| এ সময় ডাক্তাররা কেউ আমাদের রুমে না ঢুকলেও অন্য বিল্ডিং এর জানালা দিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন| দিনে দুইবেলা আমাদের রুমের সামনে খাবার সরবরাহ করা হয়েছে| সব ধরনের ওষুধ আগে থেকেই আমাদের রুমে দেওয়া ছিল এবং ডাক্তাররা ফোনে জানিয়েছেন কোন ওষুধ কখন খেতে হবে|’

গাইবান্ধা সদর উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমরা জানতে পারি দুজন মার্কিন প্রবাসী আমাদের শহরে এসেছেন| খোঁজ নিয়ে জানলাম সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশেই তাদের বাড়ি|’

‘সিভিল সার্জনের নির্দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের বলি দূর থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ করতে, তাদের মধ্যে করোনার লক্ষণ আছে কিনা| মার্চের ২০ তারিখে তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়| যখন তাদের নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ আসে, আমরা খুব ভীত হয়ে পরি এবং ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীসহ ৬ জনকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠাই।’

‘এরপরে তাদের হাসপাতালে এনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী চিকিত্সা দেওয়া শুরু করি| এর পরে ধীরে ধীরে মা- ছেলে সুস্থ্য হয়ে ওঠেন,’ বলেন গোলাম মোস্তফা।

গাইবান্ধার সিভিল সার্জন আবু হানিফ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের যে সাফল্য তার পেছনে রোগীদের সহযোগিতা অনেক কাজে লেগেছে| মার্চ মাসের ১৮ তারিখ থেকে তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়| অবশ্য তার আগে তারা দুইটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং গাজীপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে তাদের আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যান| তাদের সংস্পর্শে আসা আরও তিন জন পরে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন যাদের মধ্যে একজন বিয়ের পাত্রী| তিনিও এখন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন| এই বর ও কনের বাড়ি ছিল সুন্দরগঞ্জে| তাদেরও আইসোলেশনে নিয়ে চিকিত্সা দেওয়া হয়েছিল|’

সিভিল সার্জন জানান, ‘প্রতিমা ও তার ছেলে সৌরভকে করোনা শনাক্তের পর বাড়িতেই চিকিৎসা দেওয়া শরু করি। যেহেতু তারা ৬ জনের একটি বর্ধিত পরিবারে থাকছিলেন তাই পরিবারের বাকিদেরও নমুনা সংগ্রহ করা হয় এতে পরিবারের আরও একজনের করোনা শনাক্ত হয়। পরে তাদের তিন জনকে ২৭ মার্চ হাসপাতালের আইসোলেশনে প্রটোকল অনুযায়ী চিকিত্সা দেওয়া শুরু করি|’

‘আমি নিজে প্রতিদিন একবার করে তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি| সাহস দিয়েছি এতে করে তাদের মানসিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়| চা খাওয়ার কেটলি থেকে শুরু করে যাবতীয় কিছু তাদের রুমে সরবরাহ করা হয়| এতে তারা মানসিকভাবে চাঙা থাকেন। যা করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার জন্য খুব দরকার’. বলেন জেলা সিভিল সার্জন।

প্রতিমা সরকার জানান, ‘হাসপাতালে থাকাকালীন ৪ এপ্রিল আবার নমুনা পরীক্ষা করা হয়। সেটাতেও করোনা পজিটিভ আসে। এরপর ৮ এপ্রিল ও ১৩ এপ্রিল নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হলে দুটো রিপোর্টেই করোনা শনাক্ত হয়নি। ১৫ এপ্রিল আমাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়|’

তিনি বলেন, ‘আমাদের আসল যুদ্ধটা করতে হয়েছে রোগের বিরুদ্ধে নয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিরুদ্ধে| আশেপাশের কিছু আপনজনদের সাথে যারা না বুঝে আমাদের সমালোচনা করেছেন, নিন্দা করেছেন| গণমাধ্যমেও অনেক কিছু এসেছে| অথচ আমরা দেশেই এসেছি সেই আপন জনদের টানে| আমরা যারা বিদেশে থাকি, দেশের মাটি দেশের আনন্দ তো সবসময় মিস করি|’

‘অনেকেই সমালোচনা করেছেন, আমরা বিদেশ থেকে এসে মানুষের মধ্যে করোনা ছড়াচ্ছি কিন্তু দেশে এসে আমরা আগে দেখা করেছি আমাদের আপনজনদের সাথে যাদের আমরা খুব ভালোবাসি| যাদের জন্য আমরা নিউইয়র্ক থেকে দেশে আসি।’ ‘আমরা যদি জানতাম যে আমরা করোনায় আক্রান্ত তবে আমরা কি জেনেশুনে আমাদের আপনজনদের সাথে দেখা করতে যেতাম?’

তবে আশার কথা হলো ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাই আমাদের আরো অনেক আপনজন, শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন| আমাদের সাহস যুগিয়েছেন| ডাক্তার, সিভিল সার্জন, সাংবাদিকেরা এবং জেলা প্রশাসক আমাদের প্রতিনিয়ত খোঁজ নিয়েছেন,’ বলেন প্রতিমা সরকার।

‘আমাদের সেরে ওঠার পেছনে মানুষের সহমর্মিতা, পাশে দাঁড়ানোই বেশি কাজ করেছে। এতে আমাদের মনোবল অনেক বেড়েছে।’

‘করোনায় যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, সমাজে এখনো তাদের খারাপ ভাবে দেখা হচ্ছে | আমি বলবো তাদের সমালোচনা না করে, পাশে দাঁড়ান| তাহলে তারা করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করার মনোবল পাবে,’ বলেন প্রতিমা সরকার।

 

‘করোনায় যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, সমাজে এখনো তাদের খারাপ ভাবে দেখা হচ্ছে | আমি বলবো তাদের সমালোচনা না করে, পাশে দাঁড়ান| তাহলে তারা করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করার মনোবল পাবে,’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 − six =

Back to top button