আন্তর্জাতিক

টুইন টাওয়ার ধসে পড়া নিয়ে যত ‘ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব’

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন অনেক লোক আছেন, যাঁরা ‘ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে’ বিশ্বাসী। তাঁদের ধারণা—যেভাবে বহুল প্রচারিত অনেক ঘটনার কথা মানুষ জানে, আসলে ঘটনাটি সেভাবে ঘটেনি; বরং এর পেছনে অন্য কিছু আছে। নিজেদের ধারণার পক্ষে নানা তথ্য-প্রমাণও তাঁরা হাজির করেন।

একবিংশ শতকের যেসব ঘটনা নিয়ে এমন ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ছড়িয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলা। ওই হামলার ঘটনা ইতিহাসে ‘নাইন-ইলেভেন’ নামে পরিচিত।

‘নাইন-ইলেভেন’ হামলার দিন কথিত উগ্র ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীরা চারটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ ছিনতাই করে। দুটি উড়োজাহাজ আঘাত করে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভবনে, একটি আঘাত করে ওয়াশিংটনের পেন্টাগনে এবং আরেকটি পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে বিধ্বস্ত হয়। সব মিলিয়ে সেদিন প্রায় তিন হাজার মানুষ নিহত হয়।

নাইন-ইলেভেন নিয়ে বিচিত্র সব ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব রয়েছে। যেমন, মার্কিন সরকার বা ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা এ হামলার পেছনে ছিল; ওই আক্রমণে কোনো ইহুদি মারা যায়নি; আসলে কোনো উড়োজাহাজ টুইন টাওয়ারে বা পেন্টাগনে আঘাত করেনি—এমন নানা তত্ত্ব। আরেকটি বড় তত্ত্ব হচ্ছে, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দুটি টাওয়ার ধসে পড়েছিল উড়োজাহাজের আঘাতে নয়; বরং ভবনটির ভেতরে বিস্ফোরক বসিয়ে তা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আজ এত বছর পরও এসব তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক শেষ হয়নি। টুইন টাওয়ারে হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ছড়ায় প্রথম ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব।

ডেভিড রস্টচেক নামের এক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী লিখেছিলেন, ‘কেউ কি খেয়াল করেছেন, ওয়ার্ল্ড টেড সেন্টার ভবনটি উড়োজাহাজের আঘাতে ধ্বংস হয়নি? নাকি শুধু আমিই এটা বুঝেছি?’

ডেভিড রস্টচেকের বক্তব্য ছিল, ভবন দুটিতে উড়োজাহাজ আঘাত করেছে এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এটা ঠিক কথা; কিন্তু যেভাবে টাওয়ার দুটি ভেঙে পড়েছে, তার জন্য এর ভেতরে সঠিক জায়গায় বিস্ফোরক বসাতে হতো। এ কাজটা করতে হলে কাউকে অনেক সময় নিয়ে তা করতে হবে। প্রশ্ন হলো—প্লেনগুলোর তাহলে কী কাজ ছিল?

পরে অবশ্য তদন্ত থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে প্লেনের আঘাতের পর আগুনে টাওয়ার দুটির কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ওপরের তলাগুলো ভেঙে পড়তে থাকলে তার চাপে পুরো ভবনটিই ভেঙে পড়ে যায়।

কিন্তু এখনো কিছু লোক আছেন, যাঁরা এ কথা বিশ্বাস করেন না।

নাইন-ইলেভেন ঘটনার দিন স্পেনের লানজারোট দ্বীপে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন ম্যাট ক্যাম্পবেল। তাঁর স্ত্রী দোকান থেকে কিছু একটা কিনে ফিরে এসে বললেন, ‘নিউইয়র্কে কিছু একটা ঘটেছে।’ এরপর তাঁরা টিভিতে হামলার খবর দেখলেন।

এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খবর এলো, ম্যাটের ভাই জেফ নাকি ঘটনার সময় উত্তর দিকের টাওয়ারে ছিলেন। এর পর থেকে জেফের আর কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। জেফ তার কয়েক বছর আগে থেকে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে বসবাস করছিলেন। কাজ করতেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সে। নর্থ টাওয়ারে ১০৬ তলায় একটি সম্মেলন চলছিল, সেখানেই ছিলেন জেফ।

ম্যাট বলছিলেন, ‘আমরা সবচেয়ে খারাপ ঘটনাটিই ঘটেছে বলে ধরে নিলাম।’

নিউইয়র্কে গিয়ে নানা হাসপাতালে খোঁজ নিলেন ম্যাট দম্পতি। কোনো লাভ হলো না। তাঁরা বুঝলেন, জেফ মারা গেছেন। পরে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ধ্বংসস্তূপে জেফের কাঁধের হাড়ের একটি অংশ পাওয়া যায় ২০০২ সালে। তবে ওই ঘটনার তদন্ত শেষ হয় ২০১৩ সাল নাগাদ।

এর মধ্যেই ম্যাটের মনে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার সরকারি ভাষ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। তবে তিনি কোনো একটি নির্দিষ্ট ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না; যদিও অনলাইনে এ রকম তত্ত্বের কোনো অভাব নেই।

ম্যাট নিশ্চিত হলেন, তাঁর ভাইয়ের মৃত্যু ঠিক কীভাবে হয়েছিল, তা নিয়ে অনেক কিছু আসলে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। অনেক প্রশ্নের উত্তর তিনি পাচ্ছেন না।

ম্যাট বলেন, ‘২০০১ সালের অক্টোবর থেকেই এটা শুরু হয়েছিল। যতই দিন যাচ্ছে, আমি দেখলাম নানা রকম অসংগতির সংখ্যা বাড়ছে।’

ম্যাট জানান, তিনি তথ্য জানার অধিকার-সংক্রান্ত আইনের আশ্রয় নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ও অন্য তদন্তকারী সংস্থার কাছে ওই ঘটনার বিস্তারিত জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা নানা কারণ দেখিয়ে তথ্য জানায়নি। ম্যাট বলেন, ‘আমি এখনো তাদের কাছ থেকে প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পাইনি।’

জেফ একা নন। ক্যালিফোর্নিয়ার চ্যাপম্যান বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৬ সালে এক জরিপ চালিয়ে বলেছিল, অর্ধেকেরও বেশি আমেরিকান বিশ্বাস করে, সরকার নাইন-ইলেভেনের ঘটনা সম্পর্কে তথ্য গোপন করছে। যেসব ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব অনলাইনে ঘুরছে, তার কিছু চরম নাটকীয়।

কোনো কোনো তত্ত্বে বলা হয়েছে, মার্কিন সরকার নিজেই ওই ঘটনায় জড়িত ছিল। কেউ বলেন, মার্কিন কর্মকর্তারা ইচ্ছে করেই হামলাটি ঘটতে দিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ষড়যন্ত্র-তত্ত্বগুলো ছড়ানোর কারণ হলো—মাত্র কয়েকজন লোক মিলে এ রকম ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে, তা লোকে বিশ্বাসই করতে পারে না।

কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কারেন ডগলাস বলছেন, যখন কোনো  গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, তখন মানুষ এর একটা ব্যাখ্যা পেতে চায়। কিন্তু অনেক সময়ই সরকারি ব্যাখ্যায় মানুষকে সন্তুষ্ট হতে পারে না।

অধ্যাপক ডগলাস বলেন, ‘মানুষ চায়, ঘটনা যে মাপের, ব্যাখ্যাটাও সে মাপের হতে হবে। সেটা না পেলেই ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের জন্ম হয়।’

অন্যদিকে অনলাইন জগতে এসব তত্ত্ব ক্রমাগত প্রচার হতেই থাকে, তাই এগুলো এত বছর পরও মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি।

অধ্যাপক ডগলাস বলেছিলেন, ইন্টারনেটে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের তথ্য এমন মানুষের মধ্যেই শেয়ার হয়, যাদের চিন্তাভাবনা একই ধরনের। এ ছাড়া বেশ কিছু বই ও চলচ্চিত্র এসব ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব প্রচারে সহায়ক হয়েছে।

ডেভিড রে গ্রিফিন নামে দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক ২০০৪ সালে ‘দ্য নিউ পার্ল হারবার’ নামে একটি বই লেখেন। এতে তিনি নাইন-ইলেভেনের ঘটনায় মার্কিন সরকারের জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন।

পরিচালক ডিলান এভারির ‘লুজ চেঞ্জ’ নামের ধারাবাহিক সিরিজের প্রথম পর্বটি প্রচার হয় ২০০৫ সালে। এতে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা নিয়ে যেসব ‘জনপ্রিয়’ ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব আছে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি স্থান পায়। কোটি কোটি মানুষ এগুলো দেখেছে, ইন্টারনেটে শেয়ার করেছে। এমনকি ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর তাঁর বাড়িতেও ওই সিরিজের একটি ডিজিটাল কপি পাওয়া গেছে।

২০০৬ সালে রিচার্ড গেগ নামের একজন ক্যালিফোর্নিয়ান স্থপতি নাইন-ইলেভেনের সত্য প্রকাশের জন্য স্থপতি ও প্রকৌশলীদের একটি দল গঠন করেন, যার নাম ‘এ ই নাইন ইলেভেন ট্রুথ’। তাঁরা ওই দিনের ঘটনার সরকারি বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

বিবিসির প্রতিবেদন

নাইন-ইলেভেনের ঘটনা নিয়ে বিবিসির প্রতিবেদন নিয়েও বহু প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছিল। ঘটনাটি হচ্ছে, সেদিন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দুটি টাওয়ার ছাড়া ১০০ মিটার দূরের ডব্লিউটিসি নামের আরেকটি ৪৭ তলা ভবনও ধ্বংস হয়েছিল। কিন্তু ওই ভবনটিতে প্লেনের আঘাত লাগেনি। তবে ওই ভবন ভেঙে পড়া নিয়ে বিবিসির একটি প্রতিবেদনেও বিভ্রান্তি ও প্রশ্ন তৈরি হয়। ভবনটি আসলে যখন ভেঙে পড়েছিল, তার ২০ মিনিট আগেই বিবিসির একটি প্রতিবেদনে ভবনটি ভেঙে পড়ার খবর দেওয়া হয়।

তবে ২০০৮ সালে আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ডস ও টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আগুন লেগে ডব্লিউটিসি ভবনটির একটি প্রধান স্তম্ভ ভেঙে পড়ার পর পুরো ভবনটিই ভেঙে পড়ে। কিন্তু এ প্রতিবেদনও ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিকদের খুশি করতে পারেনি।

ম্যাট ক্যাম্পবেলও এখনো তাঁর প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

নাইন-ইলেভেন হামলার মূল হোতা খালিদ শেখ মুহাম্মদের এক বিচারপূর্ব শুনানিতে হাজিরা দেওয়ার জন্য গুয়ানতানামো বে-তে গিয়েছিলেন ম্যাট। সেই শুনানিকে ‘প্রহসন’ বলে আখ্যায়িত করেন ম্যাট ক্যাম্পবেল।

তবে ম্যাট বলেন, ‘কিন্তু আমার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার পাওয়ার সবচেয়ে কাছাকাছি আমি যেতে পেরেছি সেখানেই।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fourteen + three =

Back to top button