ট্রায়ালেই ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের টিকা “বঙ্গভ্যাক্স”
মাহামারি করোনা প্রতিরোধে বিশ্বজুড়ে চলছে টিকার প্রয়োগ। টিকা উদ্ভাবনে উন্নত দেশগুলো এগিয়ে গেলেও পিছিয়ে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো। বাংলাদেশ আমদানি করে দেশব্যাপী টিকার প্রয়োগ শুরু করলেও নিজস্ব উৎপাদনেও অনেকটা সাফল্যের কাছাকাছি।
গেলো বছরের ২ জুলাই ওষুধ প্রস্তুতকারী গ্লোব ফার্মার সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক ‘বঙ্গভ্যাক্স’ নামক টিকা তৈরির কাজ শুরুর কথা জানায়। এরই মধ্যে সেই টিকা খরগোশ ও ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করে ‘কার্যকর ও সম্পূর্ণ নিরাপদ’ প্রমাণিত হয়েছে।
এ মাসে শুরু হয়েছে বানরের ওপর পরীক্ষা, শেষ হবে আগামী মাসে। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, বিশ্বে ডেল্টাসহ ১১টি ভেরিয়েন্টের সিকোয়েন্স অ্যানালাইজ করে দেখা গেছে প্রতিটি ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রেই বঙ্গভ্যাক্স কার্যকর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত বছরের ১৫ অক্টোবর গ্লোব বায়োটেক কর্তৃক আবিষ্কৃত এমআরএনএ ভ্যাকসিনকে কভিড-১৯ টিকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। গত ডিসেম্বরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষজ্ঞদল বঙ্গভ্যাক্সের গবেষণাগার পরিদর্শন করে সব তথ্য-উপাত্ত ও প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নথিপত্র পর্যালোচনা করে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অগ্রগতিতে সহযোগিতা করে। পরবর্তী সময়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ওই গবেষণাগার ও উত্পাদনকেন্দ্র পরিদর্শন সাপেক্ষে গত ২৮ ডিসেম্বর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য ‘বঙ্গভ্যাক্স’ উৎপাদনের অনুমতি দেয়।
গ্লোব বায়োটেক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, “আমরা সরকারের সহযোগিতা পেয়েছি। যেমন—ঔষধ প্রশাসনের অনুমতি পেয়েছি। আমরা শুধু বিএমআরসির সহযোগিতা পাইনি। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নৈতিক অনুমোদন না দিয়ে বানরের শরীরে ট্রায়ালের জন্য শর্ত জুড়ে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে এই ভ্যাকসিনটি যাতে উৎপাদন করতে বা অনুমোদন পেতে আরো অনেক সময় অতিবাহিত হয়। যদি বানরের শরীরে প্রয়োগের প্রয়োজন হতো তবে বিএমআরসি আরো পাঁচ মাস আগে গ্লোব বায়োটেককে এসব শর্ত উল্লেখ করতে পারত।”
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের কোয়ালিটি অ্যান্ড রেগুলেটরির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, “আমাদের গবেষণাগারে কর্মরত বিজ্ঞানীদের অন্যান্য ওষুধের পাশাপাশি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায়, আমরা মহামারি প্রতিরোধে কভিড-১৯ শনাক্তকরণ কিট, টিকা এবং ওষুধ আবিষ্কার-সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের ২ জুলাই কভিড-১৯-এর টিকা উদ্ভাবনের ঘোষণা দিই। গ্লোব বায়োটেক কর্তৃক আবিষ্কৃত এমআরএনএ ভ্যাকসিনকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কভিড-১৯ ভ্যাকসিন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। আমরা আমাদের উদ্ভাবিত টিকাটির বঙ্গভ্যাক্স নামকরণ করেছি। এই নামের ‘বঙ্গ’ একই সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের নামকে প্রতিনিধিত্ব করে। ড. কাকন নাগ এবং ড. নাজনীন সুলতানার নেতৃত্বে তরুণ বিজ্ঞানীদের একটি চৌকস দল এ টিকা আবিষ্কার করেছে।”
গ্লোব বায়োটেকের কোয়ালিটি অ্যান্ড রেগুলেটরির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক বলেন, “আমরা প্রথমে টিকাটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য আইসিডিডিআরবির সঙ্গে কাজ করি এবং তাদের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক ড. জন ডেভিড ক্লেমেন্সসহ জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের আমাদের টিকার তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের মাধ্যমে অবহিত করি এবং তাঁরা আমাদের অত্যাধুনিক গবেষণাকেন্দ্র ও টিকা কার্যক্রম দেখে অত্যন্ত প্রশংসা করেন। কিন্তু তাঁদের ফেজ-১ ও ফেজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায়, পরবর্তী সময়ে আমরা ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন লিমিটেডের মাধ্যমে টিকাটির ফেজ-১ ও ফেজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রটোকল ইথিক্যাল ক্লিয়ারেন্সের জন্য বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদে (বিএমআরসি) গত ১৭ জানুয়ারি জমা দিই। ইথিক্যাল কমিটি প্রটোকল পর্যালোচনা করে শতাধিক বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়ে বিএমআরসি একটি চিঠি গত ৯ ফেব্রুয়ারি দেয়। আমরা সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তরসহ সংশোধিত প্রটোকল ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিএমআরসিতে জমা দিই। গত ১৮ মে আমাদের বঙ্গভ্যাক্সের গবেষণাপত্রটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ মেডিক্যাল জার্নাল ভ্যাকসিনে প্রকাশিত হয়। তখন আমরা এই খবরটি স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সব সংস্থায় চিঠি দিয়ে জানাই। তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আমরা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ব্যাপারে সহযোগিতা চাই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এদিকে দীর্ঘ পাঁচ মাস পর গত ২২ জুন বিএমআরসি থেকে আমাদের কাছে চিঠি আসে যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের আগে বানর অথবা শিম্পাঞ্জিতে টিকাটির ট্রায়াল সম্পন্ন করতে হবে। তখন আমরা খুবই কষ্ট পাই। এ বিষয়টি দীর্ঘ পাঁচ মাস পর না জানিয়ে আমরা যখন ১৭ জানুয়ারিতে বিএমআরসির কাছে আবেদন করেছিলাম, তখন জানাতে পারত।”
জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, “বানরের ওপর টিকার পরীক্ষার জন্য বিদেশে চেষ্টা করেছি। ভারত বলছে জিটুজি পদ্ধতিতে আবেদন করার জন্য। তাই সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি দিয়েছি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। কিন্তু কোনো আশানুরূপ রেজাল্ট পাইনি। আর উন্নত বিশ্বের দেশগুলো বলছে, এমআরএনএ টিকা বানরের ওপর পরীক্ষার দরকার নেই। কিন্তু বিএমআরসি বলছে, করা লাগবে। তাই বাধ্য হয়ে আন্তর্জাতিক প্রটোকল অনুসরণ করে বন বিভাগের অনুমোদন নিয়ে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক থেকে বানর সংগ্রহ করেছি। প্রয়োজনীয় অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রূপগঞ্জে আমাদের এনিম্যাল সেন্টারে আমরা এখন বানরের ওপর ট্রায়াল শুরু করেছি। ট্রায়ালটি ১ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে আগামী মাসের শেষ দিকে শেষ হবে।”
বঙ্গভ্যাক্স ভ্যাকসিনের প্রধান গবেষক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, ‘বঙ্গভ্যাক্স ইঁদুরের ওপর ট্রায়াল করে দেখা গেছে ভালো কাজ করে। এই পর্যায়ে এটি মানুষের ওপর ট্রায়াল করার জন্য বিএমআরসিতে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু তারা চাচ্ছে যে ইঁদুরের ওপর ট্রায়াল করে সরাসরি হিউম্যান ট্রায়াল (মানুষের শরীরে পরীক্ষা) না করে।