Lead Newsস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

ডেঙ্গু কী করোনায় চাপা পড়ে যাচ্ছে?

দেশে রেকর্ড সংখ্যক এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ২০১৯ সালে। গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হলেও চতুর্থ মাস থেকে ধীরে ধীরে সেটি কমে এসেছে।

আর এখন চলছে করোনা মহামারির প্রকোপ। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, করোনার প্রকোপের কারণে ডেঙ্গু হয়তো চাপা পড়ে যাচ্ছে। মানুষ আতঙ্কে রয়েছে, জ্বর হলে বাসায় থাকছে। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। হয় কোভিড নয়তো নন-কোভিড হিসেবে তাদের চিকিৎসা চলছে। উপেক্ষিত থাকছে ডেঙ্গু।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব মতে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আজ ২৮ জুন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩২২ জন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৩১৮ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় (২৭ জুন সকাল আটটা থেকে ২৮ জুন সকাল পর্যন্ত) নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন একজন রোগী।

চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু হয়নি বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। গত বছর এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর পাশাপাশি ডেঙ্গুতে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয় বলে নিশ্চিত করে আইইডিসিআর।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব থেকে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ জন, মার্চে ২৭ জন, এপ্রিলে ২৫ জন, মে মাসে ১০ জন এবং চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ১৬ জন।

গত বছরের হিসাব থেকে দেখা যায়, জানুয়ারিতে রোগী ভর্তি ছিলেন ৩৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৮ জন, মার্চে ১৭ জন, এপ্রিলে ৫৮ জন, মে মাসে ১৯৩ জন এবং জুন মাসে এক হাজার ৮৮৪ জন।

এদিকে, গত ৯ মে করোনা পরীক্ষার পাশাপাশি সন্দেহভাজন রোগীদের ডেঙ্গু পরীক্ষা করার নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে ৬৪ জেলার সিভিল সার্জন ও উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে এই নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা।

নাসিমা সুলতানা বলেন, এই আলোচনা সভায় ডেঙ্গুর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। যেহেতু করোনা এবং ডেঙ্গু রোগী উভয়ের জ্বর থাকে, সে কারণে কোভিড-১৯ পরীক্ষার পাশাপাশি সন্দেহভাজন রোগীর ডেঙ্গু পরীক্ষা করার অনুরোধ করা হয়েছে। জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি দেশের ৬৪টি জেলায় ডেঙ্গু কিট সরবরাহ করেছে।

এডিস মশার ডেনসিটি (ঘনত্ব) খুবই হাই মন্তব্য করে ডেঙ্গু নিয়ে কাজ করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, সরকারি তথ্যমতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কম। মানুষ এক ধরনের আতঙ্কে রয়েছে। জ্বর হলেই বাসায় থাকছে, হাসপাতালে যাচ্ছে না, কারণ সেখানে গেলেই তাকে করোনা ইউনিটে ভর্তি করিয়ে দিতে পারে। হাসপাতালে কেউ গেলেও সেখানে মূল ফোকাস থাকে করোনা। করোনা নেগেটিভ হলে সাধারণ জ্বর হিসেবে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু পরীক্ষাও হচ্ছে কম; মানুষ যেহেতু এখন ঘরে থাকছে বেশি, তাদের মুভমেন্ট কম, আর মুভমেন্ট কম হলে ভাইরাল ট্রান্সমিশন কম হয়। মূলত এ তিন কারণে এবারে ‘রেকর্ডেড ডেঙ্গু’ রোগী কম পাওয়া যাচ্ছে এডিসের ঘনত্ব বেশি হলেও। যে পরিমাণ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী রিপোর্টেড হচ্ছে, বাস্তবে ডেঙ্গু রোগী তার চাইতে বেশি রয়েছে। যদিও সেটা গতবছরের তুলনায় বেশি নয়।

নিয়মিত জরিপের অংশ হিসেবে নতুন এবং পুরান ঢাকা মিলিয়ে গাবতলী বাস টার্মিনাল, উত্তরা, গুলশান, শ্যামলী রিং রোড থেকে শুরু করে ধানমন্ডি, পরীবাগ ও শাঁখারীবাজারে কাজ করা হচ্ছে জানিয়ে কবিরুল বাশার বলেন, সীমিত পরিসরে এ জায়গাগুলোতে কাজ করা হচ্ছে পরিস্থিতি বোঝার জন্য। জুন মাসে প্রতিটি জায়াগায় এডিসের ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর ওপরে পাওয়া গেছে। এ থেকে বোঝা যায়, অন্য জায়গাতেও এই অবস্থা কাছাকাছিই হবে।

তিনি বলেন, মশা পরিমাপের সূচক ব্রুটো ইনডেক্স নামে পরিচিত। আর ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি হলে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়, এরকম হলে এডিস ট্রান্সমিটেড ডিজিজ হবে বলেই আমরা ধরে নেই।

তবে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর উপরে হলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে ডেঙ্গু রোগী সংখ্যা সে হারে নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, কেবল গত বছরের তুলনায় নয়, বলতে গেলে গত ১৮ বছরের তুলনাতেই চলতি বছরের শুরুর তিন মাসে রোগীর সংখ্যা বেশি।

তবে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে এসেছে মন্তব্য করে ডা. আয়শা আক্তার বলেন, গত বছর জুন মাসে রোগী সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। তবে গত বছরের চেয়ে এবারে মানুষ সচেতন। গ্রামের মানুষও সচেতন হয়েছে আগের চেয়ে। পৌরসভার মেয়ররা কাজ করছেন, একইসঙ্গে আমাদের কাজ চলছে। তবে একেবারেই সংখ্যা কম হবে তাও নয়, আশা করছি গত বছরের মতো হবে না।

ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কেমন জানতে চাইলে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, সাধারণত এর আগে দেখা গিয়েছে একাধিক মহামারি একত্রে কম হয়। তবে এটাই যে ‘ল’ তাও নয়, কারণ ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া একসঙ্গেই দেখেছি আমরা। এবারে করোনার তোড়ে ডেঙ্গু রোগী ভেসে যাচ্ছে এবং ডেঙ্গুকেও অনেকক্ষেত্রে করোনা ভাবা হচ্ছে এবং ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঘটেছে কিনা-এ বিষয়টি বোঝা যাচ্ছে না, কারণ হাসপাতালে সেটি প্রমাণিত নয়।

জ্বর হয়ে ভুগছে এমন রোগী কম আসছে হাসপাতালে, আর যারা আসছেন তারা করোনা পজিটিভ হয়ে আসছেন। আর তা না হলে নন কোভিড- গ্রিন জোনের রোগী। ফলে ডেঙ্গু রোগী কিনা সেই স্ক্রিনিং একদমই কম হচ্ছে।

সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 3 =

Back to top button