বিচিত্র

তরমুজ থেকে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু গুড়!

সুমিষ্ঠ ও উচ্চ মূল্যের একটি রসালো ফল তরমুজ। তরমুজ অপছন্দ করেন, এমন লোক মেলাভার। ফলটি সবার পছন্দের তালিকার।

কিন্তু কিছু কিছু তরমুজ সাইজে কিছুটা ছোট হয় বা আকার আকৃতিতে কিছুটা কম থাকে, ফলে গ্রেডিং এ টেকে না, যা ক্যাট নামে পরিচিত। এগুলো বিক্রি হয়না, অনেক সময় মাঠেই থেকে যায়। কোনো কোনো সময় বৃষ্টিতে পঁচে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। আবার বিক্রি না হলে অনেকেই ফেলে দেন।

কিন্তু কৃষকের কষ্ঠার্জিত এ ফসল নষ্ট বা ফেলে না দিয়ে কিভাবে কাজে লাগানো যায়, সে ভাবনা থেকেই মাথায় আসে গুড় তৈরির বিষয়টি। যা দীর্ঘ তিন বছরের ভাবনার ফসল। তরমুজের রস থেকে উৎপাদিত নতুন এ গুড়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘তোগুড়’।

বলছি তরমুজ থেকে গুড় উৎপাদন করে তাক লাগানো খুলনার কৃষক মৃত্যঞ্জয় মণ্ডলের কথা। তিনি শুনিয়েছেন এর পিছনের গল্প। এরই মধ্যেই তিনি সাড়া জাগিয়েছেন। ভাইরালও হয়েছেন ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায়।

বাজারে আখের গুড়, খেজুরের গুড়, তালের গুড় পাওয়া যায়। কিন্তু তরমুজ দিয়ে গুড় তৈরি এখন পর্যন্ত নতুন উদ্ভাবন। বিক্রি অনুপযোগী তরমুজ থেকে গুড় উৎপাদনকে গুড় শিল্পে নতুন সম্ভাবনা দেখছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

খুলনা মহানগর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরত্বে ডুমুরিয়া উপজেলা সদরের অবস্থান। উপজেলা সদর থেকে আরও ১০ কিলোমিটার দূরত্বে সাহস ইউনিয়নের ছোটবন্দ গ্রামটি অবস্থিত। এ গ্রামের কালিদাস মণ্ডলের ছেলে তরুণ কৃষক মৃত্যঞ্জয় মণ্ডল (৪০)।

কৃষক মৃত্যঞ্জয় মণ্ডল জানান, দশম শ্রেণির পর আর লেখা পড়ার সুযোগ হয়নি। ছোট বেলা থেকেই হাল ধরতে হয় সংসারের। প্রথম দিকে গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে কসমেটিক্স-প্রসাধন সামগ্রি বিক্রি করতেন। আর এরই সুবাদে বিভিন্ন জেলায় তরমুজের ক্ষেত-খামার দেখতে পান তিনি। পড়ে যান তরমুজের প্রেমে। সিদ্ধান্ত নেন তরমুজ চাষের। যেই ভাবনা, সেই কাজ। ২০০৮ সালে মাত্র ২০ শতক জমিতে প্রথম তিনিই বাণিজ্যিকভাবে ডুমুরিয়ায় তরমুজ চাষ শুরু করেন। সফলতাও পান। কিন্তু সিজনে (মৌসুমে) বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদনের কারণে মূল্য কম থাকায় লাভও কম হয়। এ কারণে সিদ্ধান্ত নেন অফসিজনে (অমৌসুমে) তরমুজ চাষের। এ ভাবনা থেকে ২০১৪ সালেও নিজের ঘেরের আইলে পরীক্ষামূলক বীজ বপন করেন। এবারও সফল তিনি। এভাবে প্রতি বছরই সিজনের পাশাপাশি অফসিজনে তরমুজ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন মৃত্যঞ্জয়। সর্বশেষ চলতি অফসিজনে ৬৫ শতক জমিতে তরমুজ চাষ করে দেড় লাখ টাকা আয় করেছেন তিনি। অথচ: শ্রমিক বাদে ব্যয় হয়েছে মাত্র ১০ হাজার টাকা। এর পাশাপাশি তিনি নিজের এবং লিজের জমিতে চুইঝাল, শসা, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, করলা ও ঢেড়সও চাষ করছেন।

কৃষক মৃত্যঞ্জয় মণ্ডল রাইজংবিডিকে জানান, সাইজে ছোট বা আকৃতিতে কম- ক্যাট তরমুজ ফেলে না দিয়ে কিভাবে কাজে লাগানো যায়- সেটি তিন বছর ধরেই ভাবনা-চিন্তা করছেন তিনি। সেই ভাবনা থেকেই প্রথম ২ অক্টোবর থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেন। ২০ কেজি তরমুজের রস বা জুসে ৫ কেজি গুড় উৎপাদন হচ্ছে। এভাবে গত ১১ দিনে তিনি প্রায় ১০-১৫ কেজি গুড় উৎপাদন করেছেন। যার প্রতিকেজি ৩শ’ টাকা করে বাজারে বিক্রিও করছেন। তবে, এ গুড়ের মান এবং খাবার উপযোগিতা স্বাস্থ্য সম্মত কিনা সে বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে তিনি বিএসটিআই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন বলেও জানিয়েছেন। আগামীতে এর উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করবেন বলে জানিয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়।

মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল কোনো রকম মেশিন ছাড়াই দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে তরমুজ কেটে এর লাল অংশ বের করে নেট দিয়ে ছেঁকে জুস বের করে চুলায় জালিয়ে ‘তোগুড়’ তৈরি করছেন। প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি এ গুড় অত্যন্ত সুস্বাদু এবং অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়।

যেভাবে তৈরি হয় তরমুজের গুড়:

প্রথমে ক্ষেত থেকে তরমুজ সংগ্রহ করতে হবে। পরে সেটি সুপেয় পানিতে ধুয়ে পরিস্কার করে কেটে টুকরো টুকরো করে একটি পাত্রে রাখতে হবে। এরপর চামচ বা শক্ত কিছু দিয়ে ভিতরের নরম অংশ অর্থ্যাৎ জুস বা রস বের করে গুলিয়ে একটি পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। পরে জুস বা রসে একটি নেট বা জালে ছেকে বিচি এবং শক্ত অংশ ফেলে দিতে হবে। পরে তরল বা নির্যাস একটি কড়াইয়ে নিয়ে চুলায় জাল দিতে হবে। এভাবে দেড় থেকে দু’ ঘণ্টা জালানোর পর ঘনত্ব হতে থাকলে চামচ বা কাঠি দিয়ে বার বার নাড়িয়ে নিতে হবে। এভাবেই ধীরে ধীরে ঘনত্ব বেড়ে বিচ পড়তে শুরু করবে এবং গুড়ে পরিণত হবে। সে ক্ষেত্রে এর মধ্যে কোনো কিছু মেশানোর প্রয়োজন হয় না। যার স্বাদ ও ঘ্রাণ অনেকটাই খেজুরের গুড়ের মত।

ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. মোছাদ্দেক হোসেন জানান, তরমুজের গুড় কৃষিতে এক নতুন সম্ভাবনা। বাণিজ্যিক ভাবে তরমুজ নিয়ে গুড় তৈরি করলে কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের ন্যয্য মূল্য পাবে। ফসলের অপচয়ও রোধ হবে। আগামীতে এটি আরও বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

তিনি জানান, আমাদের দেশের গুড় শিল্প দিন দিন সংঙ্কচিত যাচ্ছে। একদিকে তাল ও খেজুর গাছের সংখ্যা যেমন কমছে, তেমনি এ গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছির সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকা তরমুজ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। সিজনে কৃষক অনেক সময় তরমুজের ন্যয্যমূল্য পায় না এবং তরমুজের ক্যাটগুলো বিক্রিও হয়না। ফলে এ গুড়ের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 − fifteen =

Back to top button