Lead Newsদেশবাংলা

তিস্তার অকাল বন্যায় পানিবন্দী ৪০ হাজার মানুষ

কয়েকদিন আগেও তিস্তা নদী ছিল প্রায় পানিশূন্য। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে হঠাৎ করেই উজানের ঢলে হু হু করে বাড়তে থাকে পানি।

এতে তলিয়ে যায় নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল। রংপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শিশু, বৃদ্ধ ও গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা।

পানির তোড়ে ভেঙে গেছে বেশ কয়েকটি বাঁধ ও সড়ক। এতে রংপুর ও নীলফামারীর সঙ্গে লালমনিরহাটের সড়ক যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

পানিতে ভেসে গেছে বহু ফসলি জমি ও মাছ চাষের পুকুর। বন্যাকবলিতদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। কয়েকটি স্থানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণে নীলফামারীর ডালিয়া-দোয়ানী পয়েন্টে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

কুড়িগ্রাম ও রাজারহাট : কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী মাহমুদ হাসান জানান, তিস্তা তীরবর্তী রাজারহাট, উলিপুর ও চিলমারী উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এতে ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, গাছপালার ক্ষতি হয়েছে। বরোপীট ও প্রায় ৪শ’টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বন্যাকবলিতদের মাঝে শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। পরিদর্শনকালে তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরে তাসনিম ও ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ কর্মকার। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক জানান, তিস্তা এলাকায় ১৫২ হেক্টর জমির আধাপাকা ধান, সবজি, আলু ও বাদাম নিমজ্জিত হয়েছে।

রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার নুরে তাসনিম জানান, উপজেলার ঘরিয়ালডাঙ্গা, বিদ্যানন্দ ও নাজিমখান ইউনিয়নের কিছু অংশে প্রায় ৩ হাজার পরিবার বন্যাকবলিত। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ভাঙন কবলিত ৫টি এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। এর আগে মঙ্গলবার উলিপুর উপজেলার থেতরাই এলাকায় চর থেকে গরুর জন্য ঘাস নিয়ে ফেরার সময় স্রোতের টানে ভেসে গেছেন বদিউজ্জামান নামে এক কৃষক।

লালমনিরহাট : প্রচণ্ড পানির চাপে ভেঙে গেছে তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড বাইপাস সড়ক। এরপর তিস্তাপারের গ্রামগুলোতে একের পর এক সড়ক ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। শেখ হাসিনা সেতুর লালমনিরহাটের কাকিনা-মহিপুর সংযোগ সড়কের প্রায় ১৫০ মিটার ধসে গেছে। এতে রংপুরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এর আগেই তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড বাইপাস ভেঙে যাওয়ায় পার্শ্ববর্তী জেলা নীলফামারীর সঙ্গেও লালমনিরহাটের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার ৫টি উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী এলাকাগুলোর বেশ কিছু কাঁচাপাকা সড়ক ভেঙে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়ন। ওই ইউনিয়ন পরিষদের চারদিকে সড়ক ভেঙে যাওয়ায় উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন সিংঙ্গীমারীর ভেস্যিও বাঁধ ভেঙে গেছে। পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রামে পানির চাপে রাস্তার পাশাপাশি চলাচলের ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দহগ্রাম ইউনিয়নের প্রায় ১০ গ্রামের ১২৬৩ পরিবারের প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে আবাদি জমিতে লাগানো রোপা আমনের কাঁচা-পাকা ধানসহ অন্যান্য রবি ফসল।

জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানিয়েছেন, প্রায় ১৬ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব পরিবারের ত্রাণ সহায়তার জন্য ১৭৪ মে. টন চাল ও নগদ ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ জানিয়েছেন, বন্যার কারণে জেলায় ৩ হাজার ৩৮০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে ডুবে গেছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ মারকুল ইসলাম জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পুকুরের সংখ্যা ৯৩৬টি। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম নবী জানিয়েছেন, হঠাৎ বন্যায় ৪৬টি স্কুলে পানি উঠেছে।

রংপুর ও কাউনিয়া : গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অর্ধশতাধিক গ্রামের ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে মাইকিং করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা প্রশাসন। অনেকে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে ও তিস্তার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। পানির তীব্র স্রোতে রংপুর-লালমনিরহাট জেলার আঞ্চলিক সড়কের একটি অংশ ধসে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর থেকে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ কাকিনা পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ।

আকস্মিক বন্যায় নিম্নাঞ্চলের পানিবন্দি পরিবারগুলো শিশু, বৃদ্ধ ও গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। পানিবন্দি লোকজনের মধ্যে শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। তলিয়ে গেছে চরের নিম্নাঞ্চলে আবাদকৃত ধান, আলু ও রবি ফসল। এদিকে বুধবার রাতে গঙ্গাচড়া উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন রংপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি নদীভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

নীলফামারী ও ডিমলা : পানির তীব্র স্রোতে বুধবার সকাল ৯টায় নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গ্রোয়েন বাঁধ বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে ওই এলাকার বহু বসতঘর পানিতে ভেসে যায়। তিস্তার ডানতীর বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে পাঁচ শতাধিক অনেক পরিবার। এসব পরিবারের জন্য ২ হাজার ১শ শুকনো খাবার প্যাকেট, নগদ ১০ লাখ টাকা ও ৪ টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। ডিমলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সিকান্দার আলী জানান, তিস্তা অববাহিকায় প্রায় ১৫শ ৫০ হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। নদীর পানি বৃহস্পতিবার কমতে শুরু করায় ৫শ ৭৫ হেক্টর জমির ধান জেগে উঠেছে।

 

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × three =

Back to top button