নিজেদের নির্দোষ দাবী করলো আবরার হত্যা মামলার দুই আসামি
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪০(৩) ধারায় আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন দুই আসামি।এই ধারায় আইনী অধিকার বলে আসামিদের সাক্ষ্য দেয়ার বিধান রয়েছে।
সাক্ষ্য দেয়া দুই আসামি বুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মিফতাহুল ইসলাম জীওন এবং সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল নিজেদের নির্দোষ দাবি করে।
মিফতাহুল ইসলাম জীওন আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তাকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। আরেক আসামি মেহেদী হাসান রাসেল সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন, ঘটনার দিন সে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাস্থলে গিয়েছিলো।
মিফতাহুল ইসলাম জীওনের সাক্ষ্য
জীওন আদালতকে জানান, “এই মামলার ঘটনা তার জানা নাই। এই মামলার অন্য কোনো আসামিদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। মামলার ঘটনা কালিন সময় আমি বুয়েটের শেরেবাংলা হলের মেস ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলাম। আমি ঘটনার দিন মেসের সকল দায়িত্ব পালন শেষে, এসময় হলেই ছিলাম।
বিগত ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর রাতে আমি আমার কক্ষে যাওয়ার সময় বুয়েটের কয়েক জন ছাত্র, কয়েক জন সাদা পোষাকে পুলিশ দেখতে পাই। ছাত্রদের মধ্যে থেকে একজন আমাকে দেখিয়ে পুলিশকে ইঙ্গিত করেন। একজন পুলিশ অফিসার আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আমি ছাত্রলীগ করি কি না? উত্তরে আমি বলি হ্যাঁ আমি ছাত্রলীগের কর্মী। তখন তিনি আমাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলেন। আমাকে নিয়ে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে একটি সেলে আটকে রাখেন।
এরপর জামিল নামে একজন অফিসার আমার কাছে আবরারের মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। আমি তাকে জানাই আবরার নামে কাউকে চিনিনা এবং কোনোদিন দেখি নাই। তখন জামিল রেগে গিয়ে আমার পায়ে আঘাত করেন, কিল-ঘুষি ও চড় থাপ্পড় মারতে থাকেন, আমি তখন খুব অসুস্থ বোধ করি।
এরপরদিন আমাকে আদালতে নেয়া হয়। আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড দেয়। এরপর বিগত ২০১৯ সালের ৮ অক্টোবর রাজিব নামে এক অফিসারের রুমে আমাকে নেয়া হয়। তিনিও আমাকে আবরারের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। আমি একই উত্তর দিলে তিনি আমাকে চড়থাপ্পড় ও কিল-ঘুষি দিয়ে গলা চেপে ধরে দেয়ালের দিকে ছুড়ে মারেন। আমি পড়ে যাই। এরপর আবার পরদিন আমাকে রাজিব সাহেবের রুমে নেয়া হয়। সেখানে প্রচুর মারপিঠ ও শারীরিক নির্যাতন করা হয় ।
খাবার-দাবার এমন কি পানি পর্যন্ত দেয়া হয় নাই। এতটাই মারপিঠ করা হয় যে, সোজা হয়ে দাঁড়ানো বা হাতে পায়ের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পর্যন্ত পারিনি। এরপর আমার চোখ এবং হাত-পা বেঁধে সেল থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে নিয়ে আমার বুকের ওপর চাপ দিয়ে মাথায় একটি নল ঠেকিয়ে বলেন তুই যদি কথামত কাজ না করিস, তাহলে তোকে ক্রস ফায়ার দিয়ে দিব। আজকেই হবে তোর জীবনের শেষ দিন। আর যদি কথামত কাজ করিস তাহলে আর টর্চার করা হবে না। খাবার, ওষুধ সব পাবি। তখন আমি জীবন বাঁচাতে খাবার ও ওষুধ পাওয়ার জন্য তাদের কথায় রাজি হই।
এরপর আমার হাতের ও পায়ের বাঁধন খুলে অন্য এক যায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে নিয়ে আমার চোখের বাঁধন খুলে দিলে আমি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামানকে দেখতে পাই। তিনি কিছু কাগজে আমাকে সই করতে বলেন। আমি ভয়ে সই করি। এরপর বলেন কাল যেখানে নিয়ে যাব সেখানে গিয়ে একই কথা বলবি এবং একই কাজ করবি।
ম্যাজিস্ট্রেটকে যদি বলিস যে, আবরার হত্যার বিষয়ে জানিস না, তাহলে তোকে আবার রিমান্ডে নিয়ে ক্রসফায়ারে দিব। চার-পাঁচ দিন এভাবে রাখার পর আমাকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আনা হয়। সেখানে এনে আইও সাহেবের প্রিন্ট করা একটি কাগজ দেখে ম্যাজিস্ট্রেট আবার প্রিন্ট করেন। তারপর আমাকে সই করতে বলেন। আমি ভয় পেয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে সই করি।আমি এই হত্যার ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। এই ঘটনায় আমার কোনো সম্পৃক্ততা নাই।”
মেহেদী হাসান রাসেলের সাক্ষ্য
মেহেদী হাসান রাসেল তার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলে, “ঘটনার দিন সে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাস্থলে ছিলেন। এই ঘটনা সম্পর্কে সে কিছুই জানে না।
তার সারা দিনের কাজ শেষে হলে রাতে নিজের কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলো বলে ওই কর্মকর্তাকে জানায় রাসেল।
সে আদালতকে আরও জানায়, রাত ৩ টা ২০ মিনিটের সময় একজন ছাত্র এসে জানান একটি ছেলেকে কারা যেনো পিটিয়েছে, খুব সমস্যা হয়েছে। আমি তাৎক্ষণিক সেখানে ছুটে যাই, গিয়ে দেখি একটি নিথর দেহ পড়ে আছে, পাশে ডাক্তার দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
এ ঘটনায় সকাল ৭টার দিকে চকবাজার থানায় যাই। সেখানে আমাকে আটক রাখা হয়। পরদিন আমাকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আদালতে আনা হয়, আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড দেয়। আমাকে কিছুই জিজ্ঞাসাবাদ না করে ৪/৫ দিন পর আদালতে আনা হয়। আদালত আমাকে কেরানীগঞ্জের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।
আমি এই ঘটনার আদ্যোপান্ত কিছুই জানি না। তিনি আদালতকে বলেন যে ওইদিন রাত ৩ টা ২০ মিনিটের আগে আমাকে আবরার হত্যাকাণ্ডের কোনো ভিডিও ফুটেজের কোথাও পাবেন না।
এরপর প্রমাণ হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের সভাস্থলে থাকার ছবি আদালতে জমা দেন মেহেদী হাসান রাসেলের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু।তিনি দুই আসামিকে সাক্ষ্য দেয়ার সময় আদালতে সহায়তা করেন।
আজ ২৩ আগস্ট মেহেদী হাসান রাসেলের পক্ষে তার পিতা রুহুল আমিনসহ চার জনের সাফাই সাক্ষী দেয়ার কথা রয়েছে।
গত ১৪ মার্চ মামলার ২৫ আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে আদালতের কাছে ন্যায়বিচার চেয়েছেন। এরপর থেকে মামলাটি সাফাই সাক্ষ্যের জন্য রয়েছে।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে ছাত্রলীগের কিছু উশৃঙ্খল নেতাকর্মীর হাতে নির্দয় পিটুনির শিকার হয়ে মারা যান বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ। ঘটনার পরদিন নিহতের বাবা বরকতউল্লাহ বাদী হয়ে ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় একটি মামলা করেন।