অপরাধ ও দূর্ঘটনা

পাহাড়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ও সংঘর্ষ হচ্ছে কেন?

বাংলাদেশে বান্দরবান জেলার প্রত্যন্ত বাঘমারা এলাকায় এক গোলাগুলিতে ছয়জন নিহত হবার ঘটনার পেছনে পাহাড়িদের দু’টি দলের দ্বন্দ্ব কাজ করছে বলেই প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে। জেলা শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত বাঘমারা এলাকায় মঙ্গলবার ভোরে ওই গোলাগুলিতে ছয় জন নিহত এবং তিন জন আহত হয়।

বান্দরবান জেলার পুলিশ সুপার জেরিন আখতার বলেছেন, স্থানীয় পাহাঢ়ি গোষ্ঠীগুলোর দ্বন্দ্ব এবং আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ পুলিশের তদন্তে অগ্রাধিকার পাবে।

এ ঘটনা নিয়ে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়িদের আঞ্চলিক দলগুলোও পাল্টিপাল্টি অভিযোগ করছে।

‘মৃত্যুর মিছিল’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড়ে হানাহানি এবং সশস্ত্র সংঘর্ষে হত্যাকাণ্ড বা মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। স্থানীয় দলগুলোর অনেক নেতা মনে করেন, পাহাড়িদের দলগুলো বার বার বিভক্ত হচ্ছে এবং কয়েক বছরে পরিস্থিতির নতুন মেরুকরণ হয়েছে।

কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতি হয়েছে, এখন আদর্শ বাদ দিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজি মুল বিষয় হয়ে উঠেছে কিনা-এই প্রশ্ন অনেকে তুলেছেন।

স্বার্থের দ্বন্দ্ব আর ‘চুক্তি বাস্তবায়ন না হবার’ হতাশা
বিশ্লেষকরা বলেছেন, পাহাড়িদের দলগুলো তাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে বার বার বিভক্ত হয়েছে এবং সে কারণে পার্বত্য তিন জেলাতেই সশস্ত্র সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ড বেড়ে চলেছে।

২৩ বছর আগে যখন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল, তার পরপরই জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে ইউপিডিএপ নামে একটি নতুন দল গঠিত হয়েছিল।

এই দু’টি দলই এখন বিভক্ত হয়ে চারটি দল হয়েছে। এর বাইরে বান্দরবান জেলায় মিয়ানমারের সাথে সীমান্তবর্তী এলাকায় আরাকান লিবারেল পার্টি এবং মগ পার্টির তৎপরতা রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।

সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির একজন নেতা সাধুরাম ত্রিপুরা বলেছেন, সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন না করায় হতাশা থেকে দলগুলোতে দ্বন্দ্ব এবং বিভক্তি বেড়েছে।

‘চুক্তি যেহেতু বাস্তবায়ন হয় নাই, সেজন্য এখন দিশেহারা মানুষ। আর মানুষ হয়তো ধৈর্য্যহারা হয়ে এখন যার যার স্বার্থ নিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড হওয়ার দিকে চলে গেলো আরকি।’

জনসংহতি সমিতির নেতারা মনে করেন, চুক্তির মুল বিষয়গুলোর মধ্যে সেনা ক্যাম্পগুলো বন্ধ করা হয়নি এবং মীমাংসা করা হয়নি জমির অধিকারের বিষয়টিও। আর সেজন্যই দলগুলো বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন সময় সংঘর্ষে জড়াচ্ছে।

‘আদর্শ বলে কিছু আর নেই’
তবে রাঙামাটি জেলায় মানবাধিকার কর্মী টুকু তালুকদার পরিস্থিতিটাকে দেখেন ভিন্নভাবে। তিনি মনে করেন, এখন আদর্শ বলে কিছু নেই, দলের ব্যানার সামনে রেখে তারা স্বার্থের দ্বন্দ্বকে বড় করে দেখছে। সেকারণেই পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

‘আমার মনে হয়, কোন কারণে ক্ষমতার জন্যে ক্ষমতা, ক্ষমতার জন্যে লড়াই, হিংসার প্রতি হিংসা-এটাই। এই কারণেই এটা হচ্ছে। তাদের কোন লক্ষ্যই নেই।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘তারা যে চিন্তা এবং আদর্শ নিয়ে নেমেছিল, আমি জানিনা, সেই আদর্শ আছে কিনা। আমি মনে করি, তারা লক্ষ্যহীন, তারা আদর্শহীন।’

তিনি মনে করেন পাহাড়িদের দলগুলো এখন সাধারণ পাহাড়িদের মধ্যেও সমর্থন হারাচ্ছে।

পাহাড়ি দলগুলো স্বীকার করে হানাহানি বেড়ে যাবার কথা
দলগুলোও কিন্তু তাদের বিভক্তি এবং হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার বিষয় স্বীকার করে। তারা এজন্য পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করে থাকে। তবে তাদের বড় অভিযোগ সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে। ইউপিডিএফ এর একাংশের নেতা ছোটন কান্তি তঞ্চঙ্গা বলেছেন, ‘অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় বা বিভক্তি সৃষ্টি হয়। আমরা বলবো, অধিকার আদায়ের আন্দোলন যাতে দুর্বল হয়, সেজন্য এটা শাসক শ্রেণী করাচ্ছে।’

‘মনে করেন, চুক্তি হলো, চুক্তি অনুযায়ী যদি স্বায়ত্ত্বশাসন পাওয়া যেতো, তাহলে আমাদের মধ্যে বিভক্তি আসতো না। সরকার তা দিলে আমাদের মধ্যে যে তর্ক বিতর্ক বা যুদ্ধাবস্থা – এটাতো হতো না।’

জনসংহতি সমিতি থেকে বিভক্ত হয়ে জেএসএস সংস্কারপন্থী নামে দল গঠিত হয়েছে ২০০৭ সালে। এই দলের নেতারাও অভিযোগ করেছেন, তাদের মধ্যে বিভক্তি এবং পার্বত্য এলাকায় এখনকার পরিস্থিতির পিছনে সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে।

দলটির কেন্দ্রীয় নেতা সুধাকর ত্রিপুরা বলেছেন, ‘এই খানে এলাকার অধিপত্য নেয়ার বিষয় বা চাঁদাবাজির বিষয়- এগুলো সঠিক নয়। মানে আদর্শিক কারণে আমাদের বিভক্তি।’

‘নিরাপত্তা বাহিনী আর সরকার বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে’
পাহাড়িদের দলগুলোর নেতারা এটাও মনে করেন, তাদের বিরুদ্ধে আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজিসহ সহিংসতার বিভিন্ন অভিযোগ তুলে নিরাপত্তা বাহিনী বা সরকার তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা এবং রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেছেন, ‘চুক্তির পক্ষের জনসংহতি সমিতিই দুই ভাগ হয়েছে। তাদের কেউ কেউ চুক্তি বিরোধীদের সাথেও হাত মেলাচ্ছে। ফলে তারা সবাই যে এখন স্বার্থ, আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজিকে মুল কাজ হিসাবে নিয়েছে। সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।’

সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে পাহাড়ীদের দলগুলোর অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। তারা বলে আসছে, দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে পাহাড়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকছে। বাঙালীদের সংগঠনগুলোও পরিস্থিতিকে একইভাবে ব্যাখ্যা করছে।

সূত্র : বিবিসি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 + five =

Back to top button