খোলা জানালা

পেন্সিল!

সব দোষ ওই ট্রেনের। যত নষ্টের গোড়া। সময় নষ্টের কারণ। আসতে নাকি দেরি আছে খানিকক্ষণ। ওয়েটিং রুমে বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। গতি। মনে মনে হাসলাম। গতির ওপরেই চলছে দুনিয়া। আর আমার গতি নেই। আমি স্থির। জড়। রাত নেমেছে বাইরে। ঘন আঁধার। চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু উলটো ঘুরে বাইরে যাওয়ার অনিচ্ছাটা সে তেষ্টার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী।

বিশাল ওয়েটিং রুমটা যেন এক রঙ্গমঞ্চ। হরেকরকমের মানুষে বোঝাই। সারবেঁধে টিকেটের আশায় দাঁড়িয়ে আছে একদল। পোষা কুকুরের মতো ট্রলিব্যাগ নিয়ে ছুটছে কিছু যাত্রী। কিন্তু আমার অবসর। এক কোনায় একটা কফির দোকান। ঝলমলে লাল রঙে নজর কাড়ার চেষ্টা। এক ঢোক কফিতে গলা ভেজাবার তীব্র ইচ্ছাটা চাপা দিলাম জোর করে। শুনেছি, স্টেশনের সবকিছুরই দাম চড়া। ছাত্র মানুষ, পকেট ফাঁকা থাকে এমনিতেই। আরো ফাঁকা করার ইচ্ছা নেই আপাতত।

বইয়ের দোকানটার দিকে এগিয়ে গেলাম গুটি-গুটি পায়ে। ট্রেন স্টেশনের লাইব্রেরিটা বরাবরই আমাকে টানে। নানা রকমের ম্যাগাজিন পাওয়া যায়। ঈদসংখ্যাগুলোর দিকে একবার লোভাতুর দৃষ্টি ফেলে পিঠটান দিতে হলো।

মানুষে মানুষে গিজগিজ করছে ওয়েটিং রুম। তার ওপর যোগ হয়েছে গরম। বেঞ্চগুলোর ধারে কয়েকটা স্ট্যান্ড ফ্যান আছে অবশ্য। কিন্তু জনতার ভিড় ঠেলে বাতাস মুক্তি পেলেই যেন বাঁচে! ফ্যানের বাতাস পৌঁছায় না, অমন জায়গাগুলো হাহাকার করছে যাত্রীর আশায়। আমার বুকে গিয়ে আঘাত করল সে হাহাকার। গিয়ে বসলাম তেমন এক খালি বেঞ্চে।

বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুণি। এমন সময় দেখলাম লোকটাকে। মাঝবয়সী। লম্বায় আমার সমানই হবে। তবে ওইটুকুই মিল। আমার নিপাটভদ্র সাজগোজের সাথে লোকটা একদমই যায় না। উসকোখুসকো চুল। সস্তা নীল রঙের লুঙ্গি পরনে। গায়ের সাদা শার্টটা হলদে বর্ণ ধারণ করেছে। কদিন ধোয়া হয় না কে জানে। তবে আমার চোখ আটকালো তার শার্টের পকেটে। একটা ছোট্ট মাথা উঁকি দিচ্ছে ওখানে। ওই যে, রঙচঙে কিছু পেন্সিল কিনতে পাওয়া যায় না আজকাল যেগুলোর ঢাকনায় পুতুলের মুখ বসানো! তেমনই। কয়েক মাস আগে আমার ছোট বোনটাকেও কিনে দিতে হয়েছিল একটা। এছাড়া আহামরি কিছুই নেই তার মাঝে। তবুও কেন আমার চোখে পড়ল?

ঝামেলাটা না পাকালে পড়তও না। অন্য এক লোকের সঙ্গে সম্ভবত ধাক্কা খেয়েছিল সে। তারপরই শুরু হয়ে যায় তার চেঁচামেচি। তখনই তাকে দেখতে পাই আমি। উ™£ান্তের মতো কী যেন খুঁজছে মেঝেতে। লুটিয়ে পড়া লুঙ্গিতে সাফ হয়ে যাচ্ছে মেঝের ধুলাবালি। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজ কমলো বলে। মনোযোগ দিয়ে লোকটার কর্মকা- দেখতে লাগলাম। মূল্যবান কিছু হারিয়েছে কি? সাহায্য করব কি না ভাবছি। থাক, কী দরকার ঝামেলায় জড়াবার?

একটু পরেই উঠে দাঁড়াল লোকটা। তার হাতে সেই পেন্সিলটা। এটাই কি হারিয়েছিল তবে? পড়ে গিয়েছিল পকেট থেকে ধাক্কা খেয়ে? তো এভাবে পাগলের মতো খোঁজার কী আছে? সামান্য এক পেন্সিলই তো। কিন্তু না। পেন্সিল হাতে হাসি ফুটল লোকটার মুখে। নির্মল, বিশুদ্ধ হাসি। সে হাসিতে মায়া, মমতা, বিষাদ মিশে আছে একত্রে।

আবারো পকেটে নিজ জায়গা দখল করল পেন্সিলটা। যেন ওই রাজত্ব শুধু তারই। স্থান নেই অন্য কারো। লোকটাকে হেঁটে আসতে দেখলাম আমারই দিকে। ফের নজর সরালাম মোবাইলের স্ক্রিনে। টের পেলাম লোকটা এসে বসল আমার পাশে। বসেই রইল চুপচাপ। নিস্তরঙ্গ স্রোতের মতো প্রবাহিত হতে লাগল সময়। কেমন হতো যদি থমকে যেত সময়? গতি বলে কিছু কি থাকত তবে? বসে বসে হয়তো গুনত হতো অপেক্ষার প্রহর।
জলেভাসা পদ্মের মতোই বারবার মন ছাপিয়ে যাচ্ছে কৌতূহলটা। এমন কী বিশেষত্ব ওই পেন্সিলের? সফেদ কাগজে কলঙ্কের দাগ দেওয়া ছাড়া আর কী করতে পারে ওটা?
‘পেন্সিলটা কি বিশেষ কিছু?’
মুখ তুলে চাইল লোকটা। তার হাবভাবে বিহ্বলতা। আর বিষাদ। নীলবর্ণের কষ্ট।
‘আপনাকে ওভাবে খুঁজতে দেখছিলাম তো, তাই।’
সরাসরি আমার চোখের দিকে চাইল সে ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে। যেন তাকিয়ে আছে কুয়াশাচ্ছন্ন কাঁচের ওপাশ দিয়ে। ঝাপসা পুরো পৃথিবী। সবখানে শূন্যতা। অলৌকিক।
কেঁপে উঠল তার ঠোঁটজোড়া। ‘আমার… মাইয়ার…’ বলতে গিয়েও থেমে গেল। অদৃশ্য কেউ যেন চেপে ধরেছে টুঁটি। গলার কাছে এসে শব্দগুলো হারিয়ে যাচ্ছে অতল গহ্বরে। ‘মাইয়ার লাগিয়া কিনছি।’ বলতেই হাসি ফুটল তার মুখে। পরিতৃপ্তির হাসি।
‘ও আচ্ছা। আমার বোনকেও কিনে দিয়েছিলাম অমন একটা। কোন ক্লাসে পড়ে আপনার মেয়ে?’
ইতস্তত করল সে। স্মৃতির অতল থেকে তুলে আনতে চাইছে যেন বহুযুগের চাপা পড়া কিছু মুহূর্ত। কালের পরিক্রমায় ধুলো জমেছে সে পটে।
‘কেলাস ওয়ানে। বড়ো ভালা মাইয়া আমার। মন দিয়া পড়ালেখা কইরতো। ইশকুলের স্যারেরাও পছন্দ কইরতো খুব। আমারে ডাইকা বইলতো, তোমার মাইয়ার বেরেন খুব ভালা। ওর পড়ালেখা বন্ধ করবা না কখনো। আমিও স্বপ্ন দেখতাম, অনেক বড়ো হইবো আমার মাইয়া। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হইব…’ বলতে বলতে চকচক করে উঠল তার চোখ। একটু আগে বলা আশার আলো মুছে গিয়ে জমল অশ্রুবিন্দু। জমাট স্বরে বলল, ‘তা আর হইতে পারল না।’
‘কেন? পারল না কেন? ওঁর পড়ালেখা কি বন্ধ করে দিতে হয়েছে?’
‘আমি গরিব, বাজান। টানাটুনির সংসার। তাও ভাবছিলাম টেহার অভাবে মাইয়ার পড়ালেখা কখনো বন্ধ করুম না। কিন্তু… কিন্তু ছোড মাইয়াডার আবদার কখনো রাখতে পারতাম না। আমি তো এই ইস্টিশনেই কাম করতাম। মাইয়াও আইতো আমার লগে মাঝে মাঝে। একবার আইসা গিয়া দাঁড়াইল ওই লাইবেরির সামনে। আবদার ধরল একটা পেন্সিল কিন্যা দিতে। কাজের ঠেলায় মেজাজ-মর্জি ঠিক থাহে না। তার ওপর হাতে আছিল না টেহা। কিন্যা তো দেই নাই। ঠাস কইরা এক থাপ্পড় লাগাই দিছিলাম গালে। জানো বাজান, মাইয়া আমার কান্দে নাই। কেমুন কইরা যেন তাকায় আছিল। তারপর গিয়া বইসা ছিল ঠিক এই বেঞ্চিতে।’

টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে লোকটার গাল বেয়ে। সে যেন হারিয়ে গেছে অন্য কোনো ভুবনে। একমনে বলে যাচ্ছে তার কাহিনি। কে শুনছে বা শুনছে না, সে খেয়াল নেই। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো গিলছি তার কথাগুলো। বাকি পৃথিবীটা এসে যেন থমকে গেছে আমাদের ঘিরে। এক অদৃশ্য পর্দা যেন ফারাক করে রেখেছে।
‘কামের চাপে মাইয়ার কথা আর খেয়াল ছিল না আমার। অমন হইত মাঝে মাঝে। মাইয়া আমার বইসা থাকত চুপচাপ আমার কাম শেষ হওয়ার লাইগা। কিন্তু ওই দিন ছিল না। কাম শেষ কইরা ইস্টিশনে খুঁইজা পাই নাই অরে। ভাবলাম বাড়িত ফিরা গেছে একা একা রাগ কইরা। কিন্তু বাড়ি ফিরাও পাইলাম না আমার…’
কান্নায় ভেঙে পড়ল লোকটা। আশেপাশের কয়েকজন এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল এত বড় একজন মানুষকে এভাবে জনসম্মুখে কাঁদতে দেখে। তারপর আবার ফিরে গেল নিজ নিজ কাজে। সময় আজকাল বড্ড কম। অন্যের জন্য ব্যয় করার বিলাসিতা শুধু আমার মতো জড় জনেরই আছে।
বাম হাতের তালু দিয়ে মুখ মুছল লোকটা। কিন্তু ফোঁপানি গেল না। লাল চোখ নিয়ে বলতে লাগল, ‘তারপর থিক্যা কত খুঁজছি আমার বুকের ধনরে। রাগ কইরা মাইয়া আমার কই লুকাইল? পেন্সিলডা কিন্যা রাখছি ওরে দেয়ার লাইগা। কিন্তু অরে আর পাই না। অর মা অহন আর কানতে পারে না। বাড়িত ফিরা যাই যখন খালি আমার দিকে তাকায় থাহে। আর খুঁজে ওর মাইয়ারে ফিরায়া লয়ে গেছি কিনা।’ আবারো ডুকরে উঠে লোকটা। একটা চাপা যন্ত্রণায় চিনচিন করে ওঠে আমার বুকের বামপাশটা।
লাউড স্পিকারে নারীকণ্ঠ শুনতে পেলাম। আমার ট্রেন এসে গেছে। অপেক্ষার পালা শেষ। আমার জড়তা এবার কাটবার পালা। কিন্তু এই লোকটা… তার অপেক্ষার শেষ কি হবে কখনো?
‘ও বাজান, বাজান’, লোকটা আমার হাত চেপে ধরল। ‘তুমরা তো কত লেখাপড়া জানা মানুষ। কত জায়গা ঘুইরা বেড়াও। আমার মাইয়াডারে দেখলে বইলতে পারবা ওর বাপ ওর লাগি পেন্সিল কিন্যা বইসা আছে? ওর মা যে কানতে কানতে মইরবার দশা। ও বাজান, পারবা বইলতে? ওরে দেখলেই তুমি চিনতে পারবা। বেশি লম্বা না, এইটুকু। কী সুন্দর কইরা হাসবার পারে! হইলদে এক ফ্রক গায়ে…’
ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে লোকটা। আস্তে করে ছেড়ে দেয় আমার হাত। যে হাত ভরসা দিতে অক্ষম, তা আঁকড়ে ধরে কী লাভ? নিঃশব্দে বেঞ্চ থেকে আমার কাঁধব্যাগটা তুলে নিই। হলুদ ফ্রক পরা একটা মেয়ে এসে গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে লোকটার পাশে। মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে। কপোল বেয়ে ওঁর ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে অসহায়ত্বের কান্না। পিতার কাছে যেতে না পারার বেদনার।
অসহায় এক পিতাকে রেখে হাঁটতে থাকি ট্রেনের উদ্দেশে। আমার কানের কাছে কে যেন বলতে থাকে, ‘ও বাজান, বাজান…’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eighteen − 7 =

Back to top button