মাদারীপুরের রাজৈরে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে এক ইউপি সদস্য অসহায় পরিবারগুলোর কাছ থেকে ঘরপ্রতি ৬০ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ ২০ হাজার টাকাও নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
টাকার বিনিময়ে মুজিব বর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর বরাদ্দ ও জমির দলিল বুঝে পাওয়ার পর ভুক্তভোগীরা জেলা প্রশাসকের কাছে সেই টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য লিখিত আবেদনও করেছেন।
ঘর বরাদ্দের নামে টাকা আদায় করা অভিযুক্ত ওই ইউপি সদস্যের নাম তাঁরা মিয়া বেপারী। তিনি রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও রাজৈর উপজেলা মেম্বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।
জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন, রাজৈর উপজেলা ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায় দরিদ্র পরিবারকে পুনর্বাসনের গৃহীত প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পটির ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দ্বিতীয় পর্যায়ে রাজৈর উপজেলায় ১২০টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে বাজিতপুর ইউনিয়নের কামালদি এলাকায় ৩৫টি ঘর নির্মাণ করা হয়। কামালদির আগে একই ইউনিয়নে প্রথম পর্যায়ে সুতারকান্দি এলাকায় ৫৫টি ঘর নির্মাণ করা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে এসব প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় এক লাখ ৯০ হাজার টাকা। গত বছরের জুনে ঘরগুলো অসহায় পরিবারগুলোকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে উপকারভোগী পরিবারগুলো জানুয়ারি মাসে জমির দলিল বুঝে পান। টাকার বিনিময়ে তারা এ ঘর বুঝে পান। পরে ভুক্তভোগীরা জানতে পারেন সরকারি এই ঘর পেতে কোনো টাকার দরকার পড়েনি।
এরপরই ঘর বরাদ্দের জন্য ইউপি সদস্য তাঁরা মিয়া বেপারীকে দেওয়া টাকা ফেরত চান ভুক্তভোগীরা। টাকা ফেরত না দিলে মেম্বারের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন বরাদ্দ পাওয়া ঘরের বাসিন্দারা।
জেলা প্রশাসকের কাছে টাকা ফেরত চেয়ে লিখিত অভিযোগ করেন আনেচ আকন নামে এক উপকারভোগী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁরা মেম্বার জমি আর ঘর দেওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়েছেন। পরে শুনি সরকারি এই ঘরের জন্য কোনো টাকা-পয়সা লাগে নাই। পরে টাকা ফেরত চাইলে তিনি ভয় দেখান। এজন্য টাকা ফেরত পাইতে ডিসি স্যারের কাছে আবেদন করেছি।
শাওন ফকির নামে আরেক অভিযোগ প্রদানকারী বলেন, মেম্বার (তাঁরা মিয়া) বলছে, ‘ইউএনও স্যারের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। ঘরের ব্যবস্থা করে দিবে।’ পরে তিনি তার সহযোগী মাসুদ মোল্লা নামে একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। মেম্বারের কথায় যোগাযোগ করার পরে মাসুদ জানান- ঘর বরাদ্দ হয়েছে, কিন্তু জমি না। জমির দলিলের জন্য টাকা লাগবে। পরে আমার কাছ থেকে চার কিস্তিতে এক লাখ ২০ হাজার টাকা নেন মাসুদ। আমরা না বুঝে কিস্তি করে ধারদেনা কইরা অনেক কষ্টে টাকা দিছি, এখন টাকা ফেরত চাই।
কামালদি এলাকায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প এলাকায় বৃদ্ধ মাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাওয়া ঘরে থাকেন স্বামীহারা আম্বেয়া বেগম। পেশায় আম্বেয়া একজন দিনমজুর। অসহায় আম্বেয়া বেগমও একটি এনজিও থেকে ঋণ তুলে ঘরের জন্য ৬০ হাজার টাকা তুলে দেন তাঁরা মিয়ার হাতে।
আম্বেয়া বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর থিকা আর শ্বশুরবাড়িতে থাহা হয় নাই। আমার কোনো সন্তান নাই। বৃদ্ধ মা আর আমি ঘরে থাহি। আগে থাকতাম অন্যের ঘরে, এহন এই ঘরে থাহি। ঘর পাইতে টাকার কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, টাকাপায়সা ছাড়া কিছু কি আর পাওয়া যায়? আমার থেকে মেম্বার (তাঁরা মিয়া) কম নিছে। কিন্তু তাকে টাকা জোগাড় কইরা দিতে আমার অনেক কষ্ট হইছে।
রাজৈরের সুতারকান্দি এলাকার দুলাল ফকিরের স্ত্রী ময়ূরী বেগম বলেন, এই ঘর দেয়ার কথা বলে মাসুদ মোল্লা নামে একজনকে সাক্ষী করে তাঁরা মেম্বার আমার কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছে। পরে জানতে পারি সরকার এই ঘর গরিব মানুষকে ফ্রি দিয়েছে। তাহলে আমার কিস্তি ওঠানো টাকা কেন ফেরত দিচ্ছে না?
অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে ইউপি সদস্য তাঁরা মিয়া বেপারী বলেন, আমি দুইবারের মেম্বার। আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকজন এসব অসহায় মানুষদের খেপিয়ে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। তারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। আমার নামে টাকা আদায়ের অভিযোগ দিচ্ছে, তা পরিকল্পিত। আমি ঘর দেওয়ার কেউ না। টাকা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। উপকারভোগী একজনও আমার সামনে দাঁড়িয়ে টাকার কথা বলতে পারবেন না।
এ বিষয় জানতে চাইলে রাজৈর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ও আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব এইচএম মাহবুব হোসেন বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেতে কোনো টাকা দিতে হয় না। এটি অসহায় গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার। তারা মেম্বারের বিরুদ্ধে ঘর বরাদ্দের নামে টাকা নেওয়ার কথা আগেও আমরা শুনেছি। তবে কেউ টাকা দিয়ে টাকা ফেরত চেয়ে ডিসি স্যারের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন এটা আমার জানা নেই। যদি এমন কিছু হয়ে থাকে তাহলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ সম্পর্কে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও রাজৈর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনিসুজ্জামান বলেন, ডিসি স্যার বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন। তবে অভিযোগের কাগজ বা বিস্তারিত আমি এখনো পাইনি। যদি কোনো ইউপি সদস্য বা যেকোনো ব্যক্তি ঘর বরাদ্দের কথা বলে টাকা নিয়ে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে আমরা তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেব।
তিনি আরও বলেন, যারা টাকা ফেরত চেয়ে আবেদন করেছেন তারা টাকা দিয়েও অপরাধ করেছেন। যদি তারা টাকা দিয়ে থাকেন এটি প্রমাণিত হলে তাদের বরাদ্দও বাতিল হবে।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, ঘর দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়া হয়েছে, বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত রয়েছি। এরই মধ্যে অভিযোগও করেছেন অনেকেই। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।