জন্মঃ
ইসলামি রেনেসাঁসের কবি এবং ইসলামি পুনর্জাগরণের কবি হিসেবে খ্যাত, বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জ্বলতম সিতারার নাম ফররুখ আহমদ। মাগুড়া জেলার শ্রীপুর থানার মধুমতী নদীর তীরে মাঝআইল গ্রামে ১০ জুন ১৯১৮ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সৈয়দ হাতেম আলী, মাতা সৈয়দা রওশন আখতার। দাদা ছিলেন ‘খাঁন বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত সৈয়দ আব্বাস আলী। ছয় বছর বয়সে কবি মাতৃহারা হন। দীর্ঘজীবি দাদীই তাঁকে লালনপালন করেন।।
শিক্ষা জীবনঃ
কবি ফররুখ আহমদ লেখাপড়া শুরু করেন মাঝআইল গ্রামের পাঠশালায়। এ সময় ফার্সি ভাষায় দক্ষ এক মহিলার কাছে তিনি ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। তারপর ইউরোপিয়ান এ্যাসাইলাম লেনে মডেল এম.ই স্কুলে ভর্তি হন। এটি ছিলো কোলকাতার তালতলা এলাকায়। কিছুদিন বালিগঞ্জ হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন। বালিগঞ্জে লেখাপড়া করার সময়ই কবি মোস্তফা কামাল তাঁর শিক্ষক ছিলেন। অতঃপর কবি ১৯৩৭ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন এবং প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল ফজল এবং কবি আবুল হাসেম তখন তাঁর শিক্ষক ছিলেন। এ স্কুলের বার্ষিকীতে কবির কবিতা মুদ্রিত হয়।
তারপর কবি কোলকাতায় এসে রিপন কলেজে ভর্তি হন। রিপন কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন ১৯৩৯ সালে। প্রথমে দর্শন ও পরে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বি.এ ক্লাসে ভর্তি হন। তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজেও লেখাপড়া করেন। বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, প্রমথনাথ বিশীর মতো খ্যাতনামা সাহিত্যিকেরা ছিলেন কবির অধ্যাপক মণ্ডলী। উল্লেখ্য যে, এই সময়ে অধ্যাপক বিশী একদা ফররুখকে ক্লাসের খাতায় কবিতা লিখতে দেখে অভিভূত হন। তিনি খাতাটি চেয়ে নেন এবং টিচার্স কমনরুমে গিয়ে অধ্যাপকদের কবিতাগুলো আবৃত্তি করে শোনান। অভিভূত কণ্ঠে অধ্যাপক বিশী বলেন, “তিনি একজন তরুণ শেক্সপিয়ারকে আবিষ্কার করেছন”। সেসময় কবির সহপাঠীদের মধ্যে ছিলে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, অভিনেতা ফতেহ লোহানী, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। যেনকোনো কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত কবির বি.এ পরীক্ষা দেয়া হয়নি।
কর্মজীবনঃ
কোলকাতা জীবনে কবি অনেকগুলো চাকুরী করেন এবং সবগুলোই ছিলো অস্থায়ী। ১৯৪৩ সালে আই.জি. প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে, ১৯৪৫ সালে “মাসিক মোহাম্মাদী”র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে, ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে স্বল্পমেয়াদী চাকুরী করেন।
ঢাকা বেতারেই কবি দীর্ঘস্থায়ী চাকরি করেন। ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে কোলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন, ঢাকা বেতারে প্রথমে অনিয়মিত পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করতে থাকেন। মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি এই চাকুরিতেই বহাল ছিলেন।
সাহিত্য জীবনঃ
কবি ফররুখ আহমদের সাহিত্য জীবনের উন্মেষ ঘটে কোলকাতায়। সাহিত্যের বীজ অবশ্য শৈশবেই তাঁর মধ্যে প্রথিত হয়েছিলো। শৈশবে ফররুখ দাদীর কাছে পুঁথির কাহিনী, তাজকিরাতুল আউলিয়া এবং কাসাসুল আম্বিয়া শুনতেন। কবি ছিলেন দুরন্ত একি সাথে ভাবুকতা ও উদাসীনতা তাঁর মধ্যে কাজ করতো। মাঠে কিংবা মধুমতী নদীর তীরে একা একা ঘুরে বেড়াতেন। জ্যোৎস্নারাতে শুনতেন ডাহুকের ডাক। এসবই মনে হয় তাঁর মধ্যে কবিতার প্রেরণা সঞ্চার করেছিলো।
খুলনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ফররুখ কোলকাতায় পড়তে যান। এখানে থাকতেই ফররুখের সত্যিকার সাহিত্যিক উন্মেষ ঘটে।
সাল তারিখ মিলিয়ে মনে হয়, বাংলা ১৩৪৪ বা ইংরেজি ১৯৩৭ সালেই ফররুখ প্রথম সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ করেন। এ বছরেই ‘বুলবুল’ ও ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম রচনাবলী প্রকাশিত হয়। প্রপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মনে হয়, শ্রাবণ ১৩৪৪ সনে বুলবুলে প্রকাশিত ‘রাত্রি’ সনেটটিই তাঁর প্রথম মুদ্রিত কবিতা।
প্রথমদিকে ফররুখ গল্পও লিখতেন। মৃত বসুধা, যে পুতুল ডলির মা, প্রচ্ছন্ন নায়িকা, সিকান্দার শা-র ঘোড়া ইত্যাদি গল্প মাসিক বুলবুল ও মোহাম্মাদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এই সময়ে কবি ফররুখ আহমদের জীবনে এক বিশাল পরিবর্তন আসে। “সিরাজুস সালেকীন ও সাইয়্যেদুল মুরসালীন” গ্রন্থদ্বয়ের লেখক মাওলানা অধ্যাপক আব্দুল খালেকের সংস্পর্শে কবির আত্মপরিবর্তন ঘটে। পরবর্তীতে কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ “সিরাজাম মুনীরা(১৯৫২) উৎসর্গ করেন।
১৯৪৮ সালে কবি ঢাকায় চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ঢাকা বেতারে চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন দশক তিনি অবিরাম সাহিত্য চর্চা করেন। এ সময়কালে কবির চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে শিশুতোষ গ্রন্থ। নিম্নে কবির সাহিত্যকর্ম গুলো উল্লেখ করা হলোঃ
কবিতাঃ সাত সাগরের মাঝি, হে বন্য স্বপ্নেরা, কাফেলা, হাবেদা মরুর কাহিনী, দিলরুবা, কুরআন মঞ্জুষা, অনুস্বার, সিরাজাম মুনীরা, ইকবালের নির্বাচিত কবিতা, নির্বাচিত কবিতা।
ব্যঙ্গকবিতাঃ ঐতিহাসিক-অনৈতিহাসিক কাব্য, হাল্কা লেখা, বিসর্গ, তসবিরনামা, রঙ্গরস।
গানঃ রক্তগোলাব, মাহফিল, কাব্য-গীতি।
কিশোর ও শিশুতোষঃ চিড়িয়াখানা, ফুলের জলসা, কিসসা-কাহিনী, সাঁঝ সকালের কিসসা, ছড়ার আসর, আলোকলতা, খুশির ছড়া, মজার ছড়া, পাখির ছড়া, রংমশাল, জোড় হরফের খেলা, পড়ার শুরু ও পোকামাকড়।
কাব্যনাট্যঃ নৌফেল ও হাতেম, হাতেম তায়ী।
প্রবন্ধঃ ইকবাল প্রসঙ্গ, নজরুল-সাহিত্যের পটভূমি, নজরুল প্রসঙ্গ, পাকিস্তানঃ রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য, তাজকেরাতুল আউলিয়া।
ভাষা আন্দোলনে ফররুখঃ
১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন ফররুখ আহমদকে যথার্থই উদ্দীপ্ত করেছিলো। ভাষা বিষয়ে তাঁর সচেতনতা অনেক আগেই দেখা গিয়েছিল। এ সময় রেডিও-র শিল্পী সাহিত্যিকদের নিয়ে গঠিত “ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম কমিটির” অন্যতম সংগ্রামী নেতা ছিলেন কবি ফররুখ। “উর্দূ বনাম বাংলা” নামক ব্যাঙ্গকবিতায় ১৯৪৫ সালেই তিনি আতীব্র বিদ্রুপ হেনে লিখেছিলেনঃ
“দুই শো পাঁচিশ মুদ্রা যে অবধি হয়েছে বেতন
বাংলাকে তালাক দিয়া উর্দূকেই করিয়াছি নিকা”।
যা পরবর্তীতে ” মোহাম্মদী” পত্রিকায় জৈষ্ঠ ১৩৫২ সনে প্রকাশিত হয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই প্রকাশিত তাঁর “পাকিস্তানঃ রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য” প্রবন্ধে তিনি দ্বিধাহীন কণ্ঠে জানিয়েছিলেনঃ
“পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে যথেষ্ট বাদানুবাদ চলছে। আর সবচাইতে আশার কথা এই যে, আলোচনা হয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, জনগণ ও ছাত্রসমাজ অকুণ্ঠভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছে। সুতরাং এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে, পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে। যদি তাই হয়, তাহলে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে”।
ফররুখ আহমদ বাঙালি-মুসলমানের ঐতিহ্যিক স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী ছিলেন। এ ঐতিহ্যিক স্বাতন্ত্র্য সন্ধানেই চল্লিশের দশকে একদল শিক্ষিত লেখক ও কবি পুঁথিসাহিত্যের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছেন। এদিক থেকে তিনি ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করলেন। সৈয়দ আলী আহসান, মুফাখখারুল ইসলাম, আবদুর রশীদ খাঁন, আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী এবং অনেকেই ফররুখের অনুসরণে পুঁথির ধারানুবর্তী হয়েছিলো। ছাপান্ন বছরের স্বল্পজীবী জীবনে ফররুখ প্রচুর লিখেছিলেন। সমসাময়িক কবি ও বন্ধু তালিম হোসেনের ভাষায়, ” কঠোর আদর্শবাদী হলেও ফররুখ ছিলেন অন্তরঙ্গ মউজী চরিত্রের প্রাণচঞ্চল মানুষ”।
সম্মাননাঃ
ফররুখ আহমদ তাঁর জীবৎকালে চারটি পুরস্কার পানঃ প্রেসিডেন্সি পুরস্কার, ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স'(১৯৬০), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬০), ‘হাতেম তায়ী’ গ্রন্থের জন্য আদমজী পুরস্কার (১৯৬৬), ‘পাখির বাসা’ গ্রন্থের জন্য ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬০)। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকার ফররুখ আহমদকে “সিতারা-ই-ইমতিয়াজ” খেতাবে ভূষিত করলে তিনি তা প্রত্যাখান করেছিলেন।
মরণোত্তর কাল ফররুখ আহমদকে তিনটি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছেঃ একুশে পদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮০) ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার(১৯৮৪)।
শেষ জীবনঃ
১৯৭১ সালের পর ফররুখ আহমদ নিঃসঙ্গ ও গৃহবাসী হয়ে পড়েন। চাকরি সংক্রান্ত কিছু জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিলো। তা অপসারিত হয়ে ১৯৭৩ সালের মধ্যভাগে বেতারের চাকুরিতে পুনর্বহালও হয়েছিলেন, কিন্তু তখন তাঁর শরীর ও মন ক্রমাগত ভেঙে পড়তে থাকে। সাহিত্য চর্চা করেছিলেন, কিন্তু তা অভ্যাসবশতঃ। তবু তখনো তাঁর অপরাজিত সত্তা শেষ পর্যন্ত কাজ করে গেছে।
ফররুখের মৃত্যুর আগে জ্বর হয়েছিলো। শেষ কয়েক বছর অসম্ভব অর্থাভাব ছিলো, ফলে তাঁর যথাযথ চিকিৎসা হয়নি। অতঃপর ১৯ অক্টোবর ১৯৭৪ সালে সন্ধ্যাবেলায় ইস্কাটন গার্ডেনের ফ্ল্যাটে কবি ইন্তেকাল করেন।
‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় কবি সম্পর্কে বলা হয়, “কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন ইসলামি রেনেসাঁর প্রবক্তা। সত্যি বলতে কি কাজী নজরুল ইসলামের পর মুসলিম কবি হিসেবে ফররুখ আহমদই শ্রেষ্ঠ প্রতিভার দাবীদার। তিনি ইসলামি ভাবধারার অনুসারী হলেও তাঁর মতাদর্শ কখনোই তাঁর কবিসত্তাকে সংকীর্ণতায় আবদ্ধ করতে পারেনি”।
জীবনী সম্পাদনাঃ মাসুদ আলম (কাব্য)
শিক্ষার্থীঃ বাংলা বিভাগ, কারমাইকেল কলেজ।