মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে প্রবাস আয় ঝড়ের গতিতে বাড়লেও গত জুন থেকে টানা কমছে অর্থনীতির অন্যতম এই সূচক।
করোনা পরিস্থিতি উন্নতির এই সময়ে প্রবাস আয় কেন কমে যাচ্ছে তার বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ফের হুন্ডির প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে আন্ত ব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারের ডলার রেটের পার্থক্য বেশি হওয়ায় হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে বেশি উৎসাহিত হচ্ছেন প্রবাসীরা।
এ ছাড়া করোনা মহামারির কারণে যেসব প্রবাসী কাজ হারিয়েছেন তাঁদের অনেকে দেশে ফেরত এলেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে আর যেতে পারেননি। আবার যাঁরা এখন প্রবাসে আছেন তাঁদের খরচ বাড়লেও ওভারটাইম (অতিরিক্ত সময়ে কাজ) কমেছে। আবার জনশক্তি রপ্তানিও কমে গেছে। তবে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউএই ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশে নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করে দক্ষ মানবসম্পদ পাঠাতে পারলে প্রবাস আয় ভবিষ্যতে বাড়বে বলেও মনে করছেন তাঁরা।
২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরেও এই সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়ার পর থেকে প্রতি মাসেই প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি অর্থ পাঠাতে শুরু করেন। এমনকি করোনার সংক্রমণের মধ্যেও তাঁদের এই অর্থ প্রেরণ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু এখন করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সর্বশেষ অক্টোবর মাসে দেশে ১৬৫ কোটি ডলারেরও কম রেমিট্যান্স এসেছে, যা গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার মধ্যে যখন প্রবাস আয়ে অতিমাত্রায় প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল, তখনই আমি বলেছিলাম এই প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। কারণ করোনার মধ্যে অনেক প্রবাসী চাকরি হারিয়েছেন। আর যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন তাঁরা দেশে ফেরার আগেই তাঁদের সঞ্চিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আবার যাঁদের চাকরি ছিল, করোনায় তাঁদের খরচ কমায় বাড়তি অর্থ পরিবার-পরিজনের কাছে পাঠিয়েছেন। করোনাকালে সব কিছু বন্ধ থাকায় হুন্ডি পথে অর্থ পাঠানোও প্রায় বন্ধ ছিল। ফলে ওই সময় রেমিট্যান্সে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে।’
আজিজুল ইসলাম বলেন, এখন রেমিট্যান্স কমার কারণ হচ্ছে- যাঁরা চাকরি হারিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই এখন আর যেতে পারছেন না। নতুন করে বিদেশে যাওয়া লোকের সংখ্যাও কমেছে। আরেকটি বড় কারণ হলো- সম্প্রতি আন্ত ব্যাংক ডলার রেটের সঙ্গে হুন্ডি রেটের (খোলাবাজার) ব্যবধান অনেক বেড়ে গেছে। ফলে বৈধ চ্যানেলে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হলেও সেটির অপেক্ষা না করে লোকজন বেশি রেটের কারণে হুন্ডিতে অর্থ পাঠাচ্ছেন।
বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ে যাওয়ায় আন্ত ব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারের ডলার রেট কমিয়ে আনা, দক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ, বিশেষ করে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিতে জোর দেওয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মধ্যে সীমিত না থেকে জনশক্তির নতুন বাজার সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করেন এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনার সময় যে গতিতে রেমিট্যান্স এসেছিল, সেটা ছিল অস্বাভাবিক। আর এখন যে গতিতে আসছে সেটা আগেরটার সঙ্গে তুলনা করলে অনেক কম মনে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এখন যে গতিতে আসছে সেটাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, করোনার সময় দেওয়া লকডাউনে বিমান যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ ছিল। ফলে হাতে হাতে নগদ ডলার আনাও বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ প্রেরণ বেড়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে আকাশ পরিবহন শুরু হওয়ায় হাতে হাতে ডলার আসা ও হুন্ডিপ্রবণতা বেড়ে গেছে। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সব কিছু খুলতে শুরু করায় হুন্ডিপ্রবণতা আবার বাড়ছে। আবার ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনার কারণেও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। এতে রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন হয়েছে। তবে এখন যেটা আসছে সেটাই স্বাভাবিক।
করোনার মধ্যেই সদ্যঃসমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাস আয়ে বড় রেকর্ড হয়। গত অর্থবছরে প্রবাসীরা প্রায় পৌনে ২৫ বিলিয়ন ডলার বা দুই হাজার ৪৭৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছেন, যা কোনো এক অর্থবছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। এটি ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ছয় বিলিয়ন বা ৩৬ শতাংশ বেশি।