করোনাভাইরাসসাক্ষাৎকারস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

বাসায় থেকে সুস্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা জানালেন বিএসএমএমইউর অধ্যাপক

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক শহীদুল্লাহ সিকদার।

গত ৯ এপ্রিল তার সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর পরীক্ষায় তার মেয়েরও করোনাভাইরাস পজিটিভ আসে। সুস্থ হওয়ার পর তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তিনি।

শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, ‘উপসর্গ কম হলে এবং নিয়ম মেনে চলতে পারলে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ঘরে থেকে সুস্থ হওয়া সম্ভব। সেজন্য নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার, বিশ্রামের সঙ্গে কিছুটা শরীরচর্চা, প্রচুর পরিমাণে গরম পানি পান করতে হবে।’

শহীদুল্লাহ সিকদারের দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। স্ত্রী এবং ২০ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে এই চিকিৎসক থাকেন ঢাকার গ্রিন রোডের বাসায়। মেয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও এই সময়ে স্ত্রী পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন বলে জানান বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের সাবেক এই উপ-উপাচার্য।

আক্রান্ত হলেন যেভাবে

বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের চর্মরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শহীদুল্লাহ সিকদার আক্রান্ত হন এক রোগীর সংস্পর্শ থেকে। ওই রোগী নিজের উপসর্গের কথা গোপন রেখে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন।

অধ্যাপক শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমি বেশকিছু রোগী দেখছিলাম। একজন রোগীকে দেখে জ্বর… টক্সিস, টক্সিস মনে হচ্ছিল। আমি বললাম, আপনার কি করোনাভাইরাস আছে নাকি? উনি বললেন “না, আমার নেই।” এই বলে চিকিৎসা নিয়ে চলে গেলেন।

তারপর নিজে থেকে উনি পরীক্ষা করালেন। পরদিন সম্ভবত পরীক্ষা করেছেন। তার পরের দিন আইইডিসিআর থেকে আমাকে জানানো হল-‘স্যার আপনার রোগীর করোনাভাইরাস পজিটিভ। আপনি একটু সাবধানে চলেন।’

শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, ‘আমারও কিন্তু কোনো উপসর্গ ছিল না। তারপরও আমি পরীক্ষা করালাম এবং বিকেলে জানালো হলও- আমারও করোনাভাইরাস পজিটিভ। তখন আমি নিজের বাসায় একেবারে কন্টাক্টলেস হয়ে গেলাম।’

কেমন ছিল আইসোলেশনের শুরুটা?

শহীদুল্লাহ সিকদার জানান, প্রথম দিকে তার তেমন কোনো উপসর্গ ছিল না। এরপর একদিন সামান্য কাশি, সর্দি, সামান্য মাথাব্যথা।

তিনি বলেন, ‘তবে তাপমাত্রা তত বেশি ছিল না। সামান্য শরীর ব্যথা হয়েছিল। সেটা খুবই কম। আমার মেয়ের একটু জ্বর হয়েছিল, পাতলা পায়খানা হয়েছিল।’ তবে কীভাবে থাকবেন, কোথায় চিকিৎসা নেবেন, সে বিষয়ে প্রথমে নিজেও দ্বিধায় ছিলেন বলে জানালেন এই চিকিৎসক।

বিএসএমএমইউ-এর সাবেক এই উপউপাচার্য বলেন, ‘আসলে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক তো সারা দুনিয়ায় আছে। আমি যখন আক্রান্ত হলাম, টেস্ট করে যখন আমি নিজেই পজিটিভ দেখলাম, তখন আমি আসলেই একটু চিন্তিত হয়ে গেলাম যে আমি হাসপাতালে যাব না বাসায় থাকব।’

পরে ভেবে তার মনে হয়, যেহেতু বড় কোনো শারীরিক সমস্যা নেই, নিজের সঠিক পরিচর্যা করতে পারলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারলে তিনি হয়ত বাসায় থেকেও হাসপাতালের চেয়ে কম সেবা পাবেন না। সেই ভাবনা থেকেই তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন এবং মেয়ের জন্যও একই ব্যবস্থা করেন বলে জানান শহীদুল্লাহ সিকদার।

কী খেয়েছেন, কী করেছেন

শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, ‘আমি, আমার স্ত্রী ও মেয়ে আলাদা আলাদা ঘরে থেকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার চেষ্টা করেছি। প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার, বিশেষ করে স্যুপ, জুস আর গরম পানি পান করেছি সবসময়, আদা চা খেয়েছি। সবসময় চেষ্টা করেছি ভিটামিন সি ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খেতে। পেয়ারা, কমলা, লেবু, মাল্টা- এগুলো খেয়েছি প্রচুর পরিমাণে। তার সাথে কালোজিরা এবং মধু সকাল বিকেল খেয়েছি। প্রয়োজনে কিছু ওষুধও সেবন করেছি।’

অসুস্থতার দিনগুলোতে অন্য সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ পানি পান করেছেন জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘সব সময় গরম পানি পান করছি। আর সেটা পরিবারের সবাই।… বেশি বেশি পানি পান জরুরি, কারণ ভাইরাসের টক্সিস পানির সাথে বা প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে যেতে পারে।’

শহীদুল্লাহ সিকদার বলেন, অসুস্থ হলে বিশ্রাম নিতেই হয়। তাই বলে তিনি সবসময় শুয়ে থাকেননি। কিছু হালকা ব্যায়াম করেছেন, যাতে শরীর সচল থাকে।

এ সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবারে জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘সাধারণভাবে আমি সপ্তাহে একটা করে ডিম খেতাম। কিন্তু কোভিড-১৯ পজিটিভ আসার পর সপ্তাহে চারটা করে ডিম খেয়েছি। পুষ্টিকর খাবার খাওয়া খুবই জরুরি, কারণ রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারলে মানুষের সংক্রমণের শারীরিক ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়। তাতে দ্রুত সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।’

আন্তর্জাতিকভাবে বলা হচ্ছে, কোভিড-১৯ হলে সুস্থ হতে দুই থেকে ছয় সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। শহীদুল্লাহ জানান, তার ও তার মেয়ের নমুনা পরীক্ষায় দুই সপ্তাহের মধ্যেই করোনাভাইরাস নেগেটিভ এসেছে।

জটিলতা থাকলে যেতে হবে হাসপাতালে

যদি কারও আগে থেকেই ফুসফুস, হৃদযন্ত্র বা কিডনিতে জটিলতা থাকে অথবা চিকিৎসার কোনো পর্যায়ে অন্য কোনো অসুস্থতা দেখা দেয়, তাহলে তাকে হাসপাতালে যাওয়ার পারামর্শ দিযেছেন শহীদুল্লাহ সিকদার।

এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমি আবারও বলছি, যদি নিয়মিত খাবার, স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং অন্যান্য বিষয়ে লক্ষ্য রাখা যায় তাহলে দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়। গরম পানির ভাপ নেওয়ার (স্টিম ইনহেলেশন) একটা বিষয় আছে। সেটাও আমরা করেছি।’

তবে বাসায় থাকলে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কক্ষে থাকার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘এক ঘর থেকে রোগী যদি আরেক ঘরে না যায় তাহলে ভাইরাস ছড়ানোর সুযোগ কমে যায়। কারণ এটা ছড়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কন্টাক্টে।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 1 =

Back to top button