Breakingশিল্প ও বাণিজ্য

বিদেশিদের মাধ্যমে অর্থ পাচার বাড়ছে

বিদেশি শ্রমিকদের বড় অংশই অবৈধ

নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিক ও প্রতিষ্ঠান। অবৈধভাবে তারা বাংলাদেশ থেকে নিজ দেশে এবং তৃতীয় কোনো দেশেও অর্থ নিয়ে যাচ্ছে।

এছাড়া বিভিন্ন জালজালিয়াতিতে এদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সম্প্রতি এ ধরনের প্রমাণ পেয়েছে দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। এসব বিদেশির বড় অংশই অনুমতি (ওয়ার্ক পারমিট) ছাড়া বাংলাদেশে কাজ করছে। এ কারণে সম্প্রতি তিন দেশের ৩৩ নাগরিক ও দুই প্রতিষ্ঠানের তথ্য তলব করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

দেশগুলো হলো- ভারত, শ্রীলংকা এবং মালয়েশিয়া। তবে সূত্র বলছে, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও আরেকটি সংস্থা থেকে এ তথ্য চাওয়া হয়েছে। এরপরই ব্যাংকগুলোতে চিঠি পাঠায় বিএফআইইউ। তবে বিডার পক্ষ থেকে কেউ কথা বলতে রাজি হয়নি।

এর আগেও ব্যাংকের এটিএম বুথে জালিয়াতি এবং জালনোট ছাপানোর কারণে নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশের বেশ কয়েকজন নাগরিককে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।

সূত্র জানায়, বেশ কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে বুধবার দুটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের তথ্য চেয়েছে বিএফআইইউ। এগুলো হলো- জেন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এবং মোজার্ট নিট লিমিটেড। জেন ইন্টারন্যাশনালের প্রধান কার্যালয়ে ধানমন্ডির ১৪ রোডের এয়ার প্লাজার ষষ্ঠ তলায়। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসসহ আরও কয়েকটি সেবা নিয়ে কাজ করছে তারা।

ঢাকায় ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশে ব্যবসা করে এ প্রতিষ্ঠান। কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেওয়া মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে রতন নামের একজন রিসিভ করেন। বিএফআইইউর চিঠি সম্পর্কে নিয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। মোজার্ট নিট লিমিটেড তৈরি পোশাকের ব্যবসা করছে। প্

রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মমিন ইসলাম। পরিচালক হিসাবে রয়েছেন মোহাম্মদ তানিম হাসান। গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সদস্য এই প্রতিষ্ঠান। বিএফআইইউর চিঠিতে কোম্পানির পাশাপাশি পরিচালক ও চেয়ারম্যানের তথ্য চাওয়া হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে কোম্পানিটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ওয়েবসাইটে যে নম্বর দেওয়া আছে, সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

জানতে চাইলে বিডার চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কথা বলতে পারবে। আমাদের কিছু বলার নেই।

জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিদেশি কর্মী দরকার আছে। তবে সেটার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা জরুরি। এই নীতিমালার ভিত্তিতেই নিয়োগ দিতে হবে। তিনি বলেন, যেসব বিদেশি কর্মী এখানে কাজ করছে তার সিংহভাগই অবৈধ। এরা পর্যটক হিসাবে ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে কাজ করে।

এরপর যে অর্থ আয় করে, তা অবৈধভাবে নিজ দেশে নিয়ে যায়। তার মতে, এই অপরাধের জন্য শুধু বিদেশি কর্মী দায়ী নয়। দেশে যারা এদের নিয়োগ দেয়, তাদেরও দায় রয়েছে। কারণ তারা সরকারের নিয়মনীতি মেনে নিয়োগ দেন না। পাশাপাশি রাজস্ব বোর্ড, বিভিন্ন সংস্থা এবং ইমিগ্রেশন অফিসারদের দায় রয়েছে।

তার মতে, এমনিতেই দেশে এ সংক্রান্ত নীতিমালার অভাব, এরপরও যেসব নীতিমালা রয়েছে, তারও বাস্তবায়ন নেই। ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে, এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন নয়। এজন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করতে হবে। পাশাপাশি সেগুলো সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোতে পাঠানো বিএফআইইউর চিঠিতে তিন দেশের ৩৩ নাগরিকের তথ্য পাওয়া গেছে। এরা ভারত, শ্রীলংকা ও মালয়েশিয়ার নাগরিক। এসব নাগরিকদের পাসপোর্ট নম্বর, প্রতিষ্ঠানের করদাতার শনাক্তকরণ নম্বর এবং ট্রেড লাইসেন্স উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে।

যেসব নাগরিকের তথ্য চাওয়া হয়েছে তারা হলেন-আমানুল্লাহ চাঙলা, আবদুল বাসিত আবদুল শেরিফ, সাথী নারায়ণ, সেট্টি পালা, বীরেন কুমার, বালু প্রকাশ থমাস, রুমানা আর্শি সাঈদ, সঞ্জীব কুমার, সান্দা পান্ডিয়ান, চিনাকান্নু, রমেশ, হেম কুমার রায়া কাননান, বিজয়া প্রাভানকার শানমুগাম, তানুজ, পেরুমানাল রমামরি মহানরাজ, জ্যাকশন ফারনান্দেজ, সেকার ডুরাজসামী, মুথুসামী সুরেশ কুমার, কানিয়ার আবদুল নাজীর আহমেদ, রাজু সেশান্দ্রি, ঈশ্বরিয়া সুব্রামানী, দীপান চুগ, অপুহামি ডন পাওলু, আরচাইজ লাকমাল প্রিয়াশান্থা, নাজিম মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, সুদর্শনা জিহান ওইজিরাথনা, আজওয়ার মোহাম্মদ আলিয়ার সামসুদ্দীন এবং মোহাম্মদ নায়েস মহিউদ্দিন বাওয়া, সিরাজুদ্দিন বিন বদরুদ্দিন, মহসীন বিন বদরুদ্দিন এবং প্রদীপ কুমার ভট্টাচার্য।

বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের নিয়ে দুই বছর আগে একটি গবেষণা করেছে টিআইবি। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশের ২১টি খাতে ৪৪টি দেশের ২ লাখ ৫০ হাজার বিদেশি নাগরিক কাজ করছে। এর মধ্যে কর দিচ্ছে মাত্র ৯ হাজার ৫শ। বাকি ২ লাখ ৪১ হাজার অবৈধ। এরা দেশ থেকে বছরে ২৬ হাজার ৪শ কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। যা পদ্মা সেতুর মোট ব্যয়ের প্রায় সমান। এর ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকা।

টিআইবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিদেশিদের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ভারতের নাগরিক। এরপর রয়েছে-চীন, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, নরওয়ে এবং নাইজেরিয়া উল্লেখযোগ্য। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিদেশি নাগকিরদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ১ হাজার ৫শ মার্কিন ডলার। আর সবমিলিয়ে বিদেশি কর্মীদের মোট বার্ষিক আয় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।

যেসব খাতে বিদেশি শ্রমিকরা কাজ করছে এগুলো হলো-তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, বায়িং হাউজ, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, মোবাইল ফোন কোম্পানি, তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়া শিল্প, চিকিৎসাসেবা, কার্গো সেবা, আন্তর্জাতিক এনজিও, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, তেল ও গ্যাস কোম্পানি, অডিট ফার্ম, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, প্রকৌশল, ফ্যাশন ডিজাইন, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন, পোলট্রি খাদ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে বৈধ বিদেশিদের সংখ্যা ৮৫ হাজার ৪৮৬। এর মধ্যে ব্যবসায়ী ৬৭ হাজার ৮৫৩, বিশেষজ্ঞ ৮ হাজার ৩শ, কর্মকর্তা ৩ হাজার ৬৮২, কারিগরি পেশাজীবী ৭২৭, খেলোয়াড় বা ক্রীড়া সংগঠক ২ হাজার ১০৫, বিনিয়োগকারী ৯২২, ব্যক্তিগত কর্মচারী ৮০৪, এনজিও কর্মী ৫৬১, প্রশিক্ষক বা গবেষক ৪শ এবং গৃহকর্মী ১৩২ জন।

আর ব্যবসায়ী বাদে ১৭ হাজার ৬৩৩ জন। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে মোট বিদেশি নাগরিক ৩৩ হাজার ৫০৪। এর মধ্যে ৯ হাজার ৬৬১ জন ব্যবসায়ী বাদে ২৩ হাজার ৭৮৮ জন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × 4 =

Back to top button