ধর্ম ও জীবন

বিয়ে নিয়ে ইসলামের বিশেষ কিছু কথা

ইসলাম পারিবারিক জীবন গঠনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। মানবজাতিকে লিভ-টুগেদারের মতো মহাঅভিশাপের হাত থেকে রক্ষা করতে বৈধভাবে যৌনচাহিদা পূরণের জন্যই মহান রাব্বুল আলামিন বিয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। সূরা ফোরকানের শেষের দিকে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এবং যারা প্রার্থনা করে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করো যারা হবে আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর এবং আমাদেরকে করো মুত্তাকিদের জন্য অনুসরণযোগ্য’ (সূরা ফুরকান : ৭৪)।

লক্ষণীয় যে, এখানে দুটি বিষয় চাওয়া হয়েছে, একটি হলো- স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি, আরেকটি হলো- মুত্তাকিদের জন্য অনুসরণযোগ্য। কাজেই, ইসলাম শুধু আল্লাহর ইবাদতই নয়; ধর্ম অর্থ শুধু আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করা এমনটা কখনো বলা হয়নি বরং এর সাথে পরিবার গঠন, বিয়ে, সন্তান-সন্ততি এগুলো লালন-পালনকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন’(সূরা রুম : ২১)।

বিয়ের মাধ্যমে আল্লাহ রিজিকের দরজা খুলে দেন। এ জন্য, যারা বিয়েহীন তাদেরকে দ্রুত বিয়ে সম্পন্ন করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিয়েহীন, তাদের বিয়ে সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ণ, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ’ (সূরা নূর : ৩২)।

যখন কেউ পবিত্রতা সংরক্ষণ ও সুন্নত পালনের উদ্দেশ্যে বিয়ে করে এবং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল ও ভরসা করে তখন আল্লাহ তাদের মধ্যে বরকত দান করেন এবং তাদেরকে দারিদ্র্যমুক্ত করেন (তাফসিরে মাজহারি)। ইসলাম বিয়ের প্রতি যুবকদের উৎসাহ দান করেছে এভাবে- ‘হে যুবকদল! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি (বিয়ের) সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে। কেননা, বিয়ে চক্ষু-দৃষ্টিকে সংযত করে এবং লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। আর যে ব্যক্তি ওই সামর্থ্য রাখে না, সে যেন রোজা রাখে। কারণ, রোজা যৌনাকাঙ্ক্ষা দমনকারী’ (বুখারি-৫০৬৫, তাওহিদ পাব : ৪৬৯৫, ইফাবা মুসলিম-১৪০০)।

স্পষ্ট বোঝা যায়, ইসলাম বিয়ের জন্য কোনো বয়স নির্ধারণ করেনি। বলা হয়েছে, সামর্থ্য থাকলে বিয়ে করবে। সামর্থ্য বলতে, শারীরিক সক্ষমতা ও ভরণ-পোষণ সম্পন্ন হওয়ার প্রতি নির্দেশ করে। অঞ্চল, পরিবেশ ও ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে শারীরিক গঠন ও দৈহিক সক্ষমতা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

অনেকে অল্প বয়সে শারীরিক সক্ষমতা লাভ করে আবার অনেকে দেরিতে সক্ষমতা লাভ করে। আর্থিক সক্ষমতা কম থাকলেও শারীরিক সক্ষমতাকে প্রাধান্য দিয়ে বিয়ে করার কথা ইসলাম বলেছে। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন।’ (সূরা নূর : ৩২) তাছাড়া আর্থিক সক্ষমতার ওপর প্রাধান্য দিতে গিয়ে দেরি করা হলে যুবক-যুবতী পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আর এ পাপের ভার তাদের বাবা-মা ও অভিভাবকের ওপরও বর্তাবে। রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মাঝে যার কোনো (পুত্র বা কন্যা) সন্তান জন্ম হয় সে যেন তার সুন্দর নাম রাখে এবং তাকে উত্তম আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়; যখন সে বালেগ অর্থাৎ সাবালক বা সাবালিকা হয়, তখন যেন তার বিয়ে দেয়; যদি সে বালেগ হয় এবং তার বিয়ে না দেয় তাহলে, সে কোনো পাপ করলে ওই পাপের দায়ভার তার বাবার ওপর বর্তাবে’ (বায়হাকি-৮১৪৫, মিশকাত-৩১৩৮)।

জমহুরদের মতে, ‘শারীরিক সক্ষমতা থাকার পর ভরণ-পোষণ ও থাকা-খাওয়ার জন্য সামান্য ব্যবস্থা থাকলে বিয়ে করা জায়েজ।’ ইমাম আবু হানিফার মতে, ‘যদি যুবক জিনায় লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয় এবং দেনমোহর ও ভরণ-পোষণের ক্ষমতা থাকে, তাহলে বিয়ে করা ফরজ’। ইসলামী অনুশাসন মেনে, পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা মনে করে বিয়ের রীতিনীতি ও আনুষ্ঠানিকতাকে সহজ করে নিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করে ফেলতে হবে।

আনুষ্ঠানিকতার নামে অহেতুক ও অপ্রাসঙ্গিক খরচ জুড়ে দিয়ে সমাজ বিয়ে ব্যবস্থাকে কঠিন করে ফেলেছে। অথচ রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে বিয়েতে খরচ কম হয় সে বিয়েতে আল্লাহর রহমত ও বরকত বেশি থাকে।’ হাদিসে এসেছে, তিন ব্যক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহর ওপর দায়িত্ব হয়ে যায়; তাদের একজন- যে ব্যক্তি নিজের শালীনতা, চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য বিয়ে করে; আল্লাহ তায়ালা ওই ব্যক্তিকে সাহায্য করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন’। ঈমানের পূর্ণতা দানের ক্ষেত্রেও বিয়ের গুরুত্ব রয়েছে। মহানবী সা: বলেছেন, ‘মুসলিম যখন বিয়ে করে, তখন সে তার অর্ধেক ঈমান পূর্ণ করে, অতএব বাকি অর্ধেকাংশে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে’ (সহিহুল জামে-৬১৪৮, মিশকাত : ২/২৬৮)।

কুরআনের নির্দেশনা হচ্ছে, ‘আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি স্বাধীন মুসলমান নারীকে বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে না, সে তোমাদের অধিকারভুক্ত মুসলিম ক্রীতদাসীদেরকে বিয়ে করবে। আল্লাহ তোমাদের ঈমান সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত রয়েছেন’ (সূরা নিসা : ২৫)। তাই দেরি না করে, পাত্র-পাত্রী ও অভিভাবকের দেখাশোনার (পছন্দ-অপছন্দের) ভিত্তিতে বিয়ের কাজ সেরে ফেলা উচিত।

হাদিসে এসেছে, ‘সন্তানের বিয়ের জন্য দ্বীনদার ও চরিত্রবান পাত্র-পাত্রীর প্রস্তাব পেলে বিয়ে দাও। অন্যথায় পৃথিবীতে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়বে’ (তিরমিজি, হা-১০৮৫)। পাত্রী পছন্দের ক্ষেত্রে ইসলাম যে চারটি শর্তারোপ করেছে তার মধ্যে দু’টি বিষয় (আমল-আখলাক ও দ্বীনদারিতাকে) বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে আত্মীয়তা করার কথা বলেছে ইসলাম।

আল্লাহ তায়ালা আরো কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘যারা চায় যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (সূরা নূর : ১৯)। কাজেই আর্থিক সচ্ছলতা, স্বাবলম্বিতা, উন্নতি, অগ্রগতি এসবকে বেশি প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিয়ে দেরি করা ইসলাম পছন্দ করে না। এ ব্যাপারে অভিভাবক ও সমাজকে সচেতন হতে হবে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা, কাবিননামা ও অন্যান্য অপ্রাসঙ্গিক খরচ কমিয়ে এনে এ রীতিকে সহজবান্ধব করে দিতে হবে; যা বর্তমান সময়ের অনিবার্য দাবি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

12 − three =

Back to top button