ধর্ম ও জীবন

মনের অস্থিরতা দূর করার আমল

মানসিক অস্থিরতার কারণে নামাজ-রোজা ও ইবাদত-বন্দেগিসহ কোনো কাজেই মন বসছে না। সব কাজেই প্রচণ্ড অস্থিরতা কাজ করছে। এমন সময় মনের অস্থিরতা দূর করতে কী করবেন? এ অবস্থায় ইসলামের দিকনির্দেশনাই বা কী?

যে কোনো কাজের জন্যই মানসিক অস্থিরতা একটি মারাত্মক ব্যাধি। মনের অস্থিরতা দূর করতে রয়েছে কার্যকরী আমল ও দোয়া। ইসলামের দিকনির্দেশনা মেনে চললে নিঃসন্দেহে মনের অস্থিরতা দূর হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ।

মনের অস্থিরতা দূর করার আমল

কোরআন-সুন্নায় মনের অস্থিরতা দূর করার সবচেয়ে উত্তম আমল বা চিকিৎসার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাহলো,

১. আল্লাহর জিকির করা।

জিকির করলে অন্তরে প্রশান্তি আসে। কেননা মুমিন মুসলমানের অন্তরের খোরাক হলো জিকির, ইবাদত, কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া-মোনাজাত। মহান আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টি কোরআনুল কারিমে এভাবে তুলে ধরেছেন-

الَّذِينَ آمَنُواْ وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللّهِ أَلاَ بِذِكْرِ اللّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

যারা বিশ্বাস করেছে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। জেনে রাখ! আল্লাহর স্মরণেই (মানুষের) অন্তর প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রাদ : আয়াত ২৮)

২. কোরআন তেলাওয়াত করা।

কোরআন তেলাওয়াতেও মানুষের মনের অস্থিরতা দূর হয়। কোরআন তেলাওয়াতের ফলে অন্তরে জান্নাতি আবহ তৈরি হয়। এ কোরআন মানুষের জন্য মানসিকসহ অনেক রোগের সুচিকিৎসা এবং রহমত। আল্লাহ তাআলা বলেন-

نُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاء وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ وَلاَ يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إَلاَّ خَسَارًا

‘আমি কোরআনে এমন বিষয় নাজিল করেছি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত। গোনাহগারদের তো এতে শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ৮২)

৩. নামাজে মনোযোগী হওয়া।

মনে অস্থিরতা তৈরি হলে নামাজে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করা। কারণ নামাজও মানুষের মনের অস্থিরতা দূর করে দেয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অস্থির অবস্থায় নামাজের মাধ্যমে প্রশান্তি পেতেন। কোরআন-সুন্নায় এ বিষয়টিও সুস্পষ্ট। অস্থিরতা দূর করতে নামাজের ভূমিকা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنَّ الْإِنسَانَ خُلِقَ هَلُوعًا إِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوعًا وَإِذَا مَسَّهُ الْخَيْرُ مَنُوعًا إِلَّا الْمُصَلِّينَ الَّذِينَ هُمْ عَلَىٰ صَلَاتِهِمْ دَائِمُونَ

‘নিশ্চয়ই মানুষ ভীরুরূপে সৃজিত হয়েছে। যখন তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে হা-হুতাশ করে (মনে অস্থিরতা তৈরি হয়)। আর যখন কল্যাণপ্রাপ্ত হয়, তখন কৃপণ হয়ে যায়। তবে তারা স্বতন্ত্র, যারা নামাজ আদায়কারী। যারা তাদের নামাজে সার্বক্ষণিক কায়েম থাকে।’ (সুরা মাআরিজ : আয়াত ১৮-২৩)

হাদিসে এসেছে, وكان –ﷺ– إذا حزبه أمرٌ فزِعَ إلى الصلاة রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন অস্থির হয়ে যেতেন তখন তিনি নামাজে দাড়িয়ে যেতেন।’ (আবু দাউদ)

শুধু তা-ই নয়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলতেন, হে বেলাল- أقم الصلاة أرحنا بها নামাজের ইকামত দাও; এর মাধ্যমে আমাকে প্রশান্তি দাও।’ (আবু দাউদ)

৪. অলস সময় ব্যয় না করা।

অলসতা একটি মারাত্মক রোগ। এটি এমন রোগ যা বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর ও অস্বস্তিকর চিন্তা, অস্থিরতা ও পেরেশানি টেনে আনে। যার কারণে মন অস্থির হয়ে ওঠে। সুতরাং যখনই মনের অস্থিরতা দেখা দেবে তখনই অলস বসে না থেকে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও জিকির করা, কোরআন তেলাওয়াত করা কিংবা নামাজ পড়া শুরু করা জরুরি। ফলে এসব আমলে দূর হয়ে যাবে মনের সব অস্থিরতা ও পেরেশানি।

মনের অস্থিরতা দূর করার দোয়া

উল্লেখিত আমলগুলোর পাশাপাশি মনের অস্থিরতা দূর করতে রয়েছে বেশকিছু দোয়া। হাদিসে পাকে এ দোয়াগুলো অস্থিরতা ও পেরেশানগ্রস্থ লোকদের জন্য তুলে ধরা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এ দোয়াগুলো পড়তেন।

১. হজরত আব্দুর রহমান ইবনু আবি বাকরা রাদিয়াল্লাহু আনহু তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত (মনের অস্থিরতাগ্রস্ত) ব্যক্তির দোয়া হলো-

اَللَّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو، فَلاَ تَكِلْنِي إِلَى نَفْسِي طَرْفَةَ عَيْنٍ، وَأَصْلِحْ لِي شَأْنِي كُلَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা রাহমাতাকা আরঝু; ফালা তাকিলনি ইলা নাফসি ত্বারফাতা আইনিন; ওয়া আসলিহ লি শানি কুল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহ আনতা।’

অর্থ : হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে রহমত (মনের প্রশান্তি) কামনা করছি। তুমি আমাকে এক মুহূর্তও আমার নিজের (মনের) ওপর ছেড়ে দিও না। বরং তুমি নিজেই আমার সমস্ত ব্যাপার ঠিক করে দাও। তুমি ব্যতিত (মনের অস্থিরতা ও বিপদ থেকে রক্ষাকারী) কোনো ইলাহ নেই।’ (আদাবুল মুফরাদ, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ)

২.হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার সময় আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন-

لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ الْعَظِيمُ الْحَلِيمُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ السَّمَوَاتِ، وَرَبُّ الْأَرْضِ، وَرَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ

উচ্চারণ : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুল আজিমুল হালিম; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু রাব্বুল আরশিল আজিম; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু রাব্বুস সামাওয়াতি ওয়া রাব্বুল আরদি ওয়া রাব্বুল আ’রশিল কারিম।’

অর্থ : ‘আল্লাহ্ ব্যতিত সত্য কোনো মাবুদ নেই, তিনি অতি মহান, অতি সহনশীল। আল্লাহ ব্যতিত কোনো সত্য ইলাহ বা উপাস্য নেই, তিনি বিশাল আরশের মালিক। আল্লাহ ব্যতিত সত্য কোনো মাবুদ নেই, তিনি আসমান-জমিনের এবং মহান আরশের অধিপতি।’ (বুখারি)

৩. হজরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন-

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ وَأضَلَعَ الدَّيْنِ وَ غَلَبَةِ الرِّجَالِ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়াল আঝযি ওয়াল কাসালি, ওয়াল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া দালাইদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।’ (নাসাঈ)

অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি চিন্তা-ভাবনা, অপারগতা, অলসতা, কৃপণতা এবং কাপুরুষতা থেকে। অধিক ঋণ থেকে এবং দুষ্টু লোকের প্রাধান্য থেকে।’ (বুখারি)

৪. হজরত আসমা বিনতে উমাইস রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেন, ‘আমি কি তোমাকে এমন কিছু বাক্য শেখাব না; যা তুমি দুঃশ্চিন্তার (মনের অস্থিরতার) সময় পড়বে? তাহলো-

اَللهُ اَللهُ رَبِّىْ لَا اُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا

উচ্চারণ : ‘আল্লাহু আল্লাহু রাব্বি; লা উশরিকু বিহি শাইআ।’

অর্থ : ‘হে আল্লাহ! তুমিই আমার প্রভু, আল্লাহ…। আমি তোমার সঙ্গে কাউকে শরিক করি না।’ (আবু দাউদ)

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, কোনো কারণে মনে অস্থিরতা তৈরি হলে কোরআন-সুন্নাহর আমলগুলোর পাশাপাশি হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলো যথাযথভাবে পড়া। হাদিসের বর্ণিত প্রিয় নবির শেখানো দোয়াগুলো পড়ে মনের অস্থিরতা ও পেরেশানি দূর করার চেষ্টা করা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে চিকিৎসাগ্রহণ ও আমল করে মনের অস্থিরতা দূর করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের উপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 + eighteen =

Back to top button