যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের পাশে চীন-পাকিস্তান
তালেবান শাসনের অধীনে আফগানিস্তানের জন্য মানবিক ত্রাণ দেয়ার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য সোমবার আন্তর্জাতিক দাতারা জেনেভায় আলোচনায় বসেন। এদিকে প্রতিবেশী চীন ও পাকিস্তান ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানে সাহায্য পৌঁছে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো সহায়তা দেয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি সংকটে রয়েছে এবং একটি মানবিক সংকট চলছে। তবুও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো তালেবানদের তহবিল সরবরাহ করতে অনিচ্ছুক যতক্ষণ না নতুন শাসকরা এই আশ্বাস দেয় যে, তারা মানবাধিকার এবং বিশেষ করে পশ্চিমা স্টাইলে মহিলাদের অধিকারকে সমর্থন করবে। আফগানিস্তানের প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে, যা বাইডেন প্রশাসন হিমায়িত করে রেখেছে।”
আফগানিস্তানের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি ডেবোরা লিওন্স চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে বলেন, “এই তহবিলগুলো প্রকৃত তালেবান প্রশাসনকে দিতে অস্বীকার করার উদ্দেশ্য বোধগম্য। অবশ্য এর অনিবার্য প্রভাব একটি মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দা, যা আরও অনেক লাখ মানুষকে দারিদ্র্য এবং ক্ষুধার মধ্যে ফেলে দিতে পারে। আফগানিস্তান থেকে শরণার্থীদের একটি বিশাল স্রোত সৃষ্টি হতে পারে এবং প্রকৃতপক্ষে দেশটিকে প্রজন্মের জন্য পিছিয়ে দিতে পারে।”
আরেকটি সম্ভাব্য প্রভাব হতে পারে আফগানিস্তানকে তার প্রতিবেশী এবং ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তান এবং চীনের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া, যারা ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানে বিমান ভরে সহায়তা পাঠিয়েছে। তারা ইঙ্গিতও দিয়েছে যে, তারা সহযোগিতার জন্য উন্মুক্ত।
চীন গত সপ্তাহে আফগানিস্তানে ৩১ কোটি ডলার মূল্যের খাদ্য ও স্বাস্থ্য সামগ্রী পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে, যা গত মাসে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম বৈদেশিক সাহায্যের অঙ্গীকারের মধ্যে পড়ে। পাকিস্তান গত সপ্তাহে কাবুলের কর্তৃপক্ষের কাছে রান্নার তেল এবং ওষুধের মতো সামগ্রী পাঠিয়েছিল, যখন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি শর্ত ছাড়াই সহায়তা প্রদানের এবং আফগানিস্তানের সম্পদ মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
চীন, পাকিস্তানের সাথে একটি শক্তিশালী জোটের মাধ্যমে তালেবানদের সাথেও জড়িত। কিছু বিশ্লেষক বলেছেন যে, “তারা আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ দ্বারা প্রলুব্ধ হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে লিথিয়ামের বড় মজুদ যা বৈদ্যুতিক যানবাহনের মূল উপাদান। চীন আফগানিস্তান থেকে তার সীমান্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়া জঙ্গিবাদ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এ বিষয়ে তারা তালেবান প্রশাসনকে সাহায্য করতে চায়। মানবিক সাহায্যের বাইরে, এই অঞ্চলের কিছু বিশেষজ্ঞ এবং কর্মকর্তারা বলছেন, চীনের বিশাল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) আফগানিস্তানকে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক কার্যকারিতা প্রদান করতে পারে।”
একটি সম্ভাবনা হল, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে (সিপিইসি) আফগানিস্তান যোগদান করবে। এটি বিআরআই এর একটি কেন্দ্রীয় অংশ, যার অধীনে বেইজিং পাকিস্তানে অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য ৬ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার বেশিরভাগই ঋণের আকারে। আফগানিস্তানে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত রুস্তম শাহ মোহমন্দ বলেছেন, “তালেবানরা সিপিইসিতে যোগদানকে স্বাগত জানাবে, চীনও খুব খুশি হবে।”
চীন বিআরআই নিয়ে কোন মন্তব্য করেনি কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন যে, বেইজিং সক্রিয়ভাবে চীন-আফগানিস্তান মালবাহী ট্রেন পুনরায় চালু করতে এবং বাইরের বিশ্বের সাথে আফগানিস্তানের যোগাযোগ ও বিশেষ করে মানবিক সরবরাহে প্রবেশাধিকার সহজতর করার জন্য প্রস্তুত।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তালেবান নেতারা বলেছেন যে, তারা চীনের সাথে সুসম্পর্ক চায়। তালেবানের উর্ধ্বতন একটি সূত্র জানিয়েছে, দোহায় চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য বিনিয়োগের সুযোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চীন বিশেষ করে খনিতে আগ্রহী কিন্তু সেক্টরের যেকোনো কার্যক্রম টেন্ডারের জন্য উন্মুক্ত থাকবে, সূত্রটি জানিয়েছে। তিনি বলেন, ‘তালেবান বিদেশী বিনিয়োগকে স্বাগত জানায় যা দেশকে উপকৃত করবে।’ আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের এই বিষয়ে পরিচিত দুটি সূত্র বলেছে যে, চীন বহু বছর ধরে আফগানিস্তানকে সিপিইসি-তে যোগদানের জন্য সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করে আসছে কিন্তু পূর্ববর্তী মার্কিন-সমর্থিত সরকারের কাছ থেকে তারা কোন প্রতিশ্রুতি পায়নি।
অর্থনৈতিক উদ্দীপনা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রয়োজনসহ বিভিন্ন কারণে এ বিষয়ে তালেবানকে আরো বেশি আগ্রহী বলে মনে হয়। পাকিস্তানের সিনেটর এবং চীন-পাকিস্তান ইনস্টিটিউটের সাবেক চেয়ারম্যান মুশাহিদ হুসাইন সাইদ বলেন, ‘আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় এবং অবিলম্বে উপলব্ধ বিকল্প হচ্ছে সিপিইসি, যার মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান ও চীন। কাবুলের নতুন প্রশাসনও এটি গ্রহণ করবে এবং তারা এর জন্য আগ্রহী।’
যদিও আফগানিস্তানের অনিশ্চিত নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় চীনের জন্য আরও যে কোনো বিনিয়োগ ঝুঁকি নিয়ে আসতে পারে। সেন্টার ফর চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের প্রেসিডেন্ট ওয়াং হুয়াও বলেন, ‘আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা চীনের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি বলেন, “কিন্তু মধ্য এশিয়ার সাথে সংযোগ এবং বেল্ট অ্যান্ড রোডের মাধ্যমে সংযোগ, এটি সবই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত … চীনের জন্য সেখানে একটি অংশ রয়েছে।”
সূত্র: ট্রিবিউন।