রক্তের গ্রুপ না মিললেও কিডনি প্রতিস্থাপন
কারো শরীরে যদি অন্য গ্রুপের রক্ত দেওয়া হয় তাহলে জটিলতা তৈরি হয়। এ জন্যই রক্ত দেওয়ার আগে উভয়ের রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, ক্রস-ম্যাচিংসহ নানা পরীক্ষার পর রক্ত দেওয়ার নিয়ম করা হয়েছে। যেমন ‘ও’ গ্রুপের ব্যক্তি ‘ও’ গ্রুপ রোগীকেই কিডনি দিতে পারে। সে জন্য এ ধরনের রক্তের গ্রুপকে ইউনিভার্সেল বা সর্বজনীন ডোনার বলা হয়। ঠিক তেমনি রোগীর যদি এ-বি ব্লাড গ্রুপ হয় তাহলে সে যেকোনো গ্রুপের রক্ত গ্রহণ করতে পারে এবং সেই জন্য এ ধরনের রোগীকে বলা হয় ইউনিভার্সেল বা সবজনীন প্রাপক। কিন্তু এ গ্রুপের ডোনার শুধু ‘এ’ গ্রুপ রোগীকেই কিডনি দিতে পারে এবং ‘বি’ গ্রুপের ডোনার শুধু বি গ্রুপকেই রক্ত দিতে পারবে।
সুতরাং যদি রক্তের গ্রুপ রক্তদাতা ও গ্রহীতার জন্য মিল না থাকে, সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক জটিলতা দেখা দেবে এবং লোহিত কণিকা ভেঙে রক্ত জমাট বেঁধে রোগী মৃত্যুবরণ করবে। সে জন্য কিডনি সংযোজনের ক্ষেত্রেও রক্তের গ্রুপ এবং টিস্যু টাইপিংয়ের মিল থাকা প্রয়োজন। কিন্তু উন্নত বিশ্বে রক্তের গ্রুপের মিল নেই কিন্তু টিস্যু টাইপিংয়ের মিল আছে—এসব ক্ষেত্রে যদি মা-বাবা অথবা নিকটাত্মীয় কিডনি দাতা হিসেবে নিকটাত্মীয়কে কিডনি দিতে চায় সে ক্ষেত্রে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাকে এবিও ইনকম্পিটিবল ট্রান্সপ্ল্যান্ট বলা হয়। এসব ক্ষেত্রে কিডনি গ্রহীতার রক্ত প্লাজমা এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে কিডনি দাতার রক্তের অ্যান্টিবডি বের করে দিয়ে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়। এর সঙ্গে অপারেশনের দুই-তিন সপ্তাহ আগে রোগীকে কিছু বিশেষ ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়, ফলে ডোনারের অ্যান্টিবডি আর রোগীর কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কিডনি দানের ক্ষেত্রেও নিয়ম একই। কিডনি দাতা ও গ্রহীতার রক্তের গ্রুপে মিল থাকলেই কিডনি প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
এবিও ইনকম্পিটিবল ট্রান্সপ্লান্টেশন
আধুনিক এক চিকিৎসাপদ্ধতির নাম এবিও ইনকম্পিটিবল ট্রান্সপ্লান্টেশন (এবিও-আই) মাধ্যমে দাতা ও গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ ভিন্ন হলেও কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায়। উন্নত দেশে এ প্রক্রিয়ায় কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সাফল্যের হার ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশে কিডনি ফাউন্ডেশনে এই পদ্ধতিতে বেশ কয়েকটি সফল কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে।
কেস হিস্ট্রি
কুড়িগ্রামের ২৩ বছর বয়সী ইমরান ফিরোজের দুটি কিডনি বিকল হয়। তাঁর রক্তের গ্রুপ ছিল ‘ও’ এবং রোগীর রক্তের গ্রুপ ছিল ‘এ’ পজেটিভ। ছেলেকে বাঁচাতে নিজের কিডনি দিতে চাইলেও ইমরানের মায়ের রক্তের গ্রুপ আলাদা থাকায় জটিলতা ছিল। কেননা কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য কিডনি দাতার সঙ্গে রোগীর রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপিংয়ের যথেষ্ট মিল থাকতে হয়।
এবিও ইনকম্পিটিবল ট্রান্সপ্লান্টেশন পদ্ধতিতে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে ‘প্লাজমাফেরেসিস’ পদ্ধতিতে রক্তের প্লাজমা বা রক্তরসকে রক্তকোষ থেকে আলাদা করা হয়। একটি ছাঁকনির মাধ্যমে বারবার ছেঁকে সেখান থেকে অ্যান্টিবডিগুলো আলাদা করা হয়। আর অ্যান্টিবডি আলাদা করলে অন্য রক্তের গ্রুপের কোনো ব্যক্তির কিডনি প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকে না। ইমরান ফিরোজের অ্যান্টিবডি ছিল ১:১২৮ যা প্লাজমা এফেরেসিস মেশিনের মাধ্যমে ও কিছু ওষুধ প্রয়োগ করে ১:৮-এ নামিয়ে আনা হয়। পুরো প্রস্তুতি শেষ হতে সময় লাগে তিন সপ্তাহ। এরপরই ট্রান্সপ্লান্টের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগে তার মায়ের কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয় ইমরানের দেহে। জানা গেছে, ইমরান ট্রান্সপ্লান্ট করার পরও এক বছর পরও পুরোপুরি সুস্থ আছে ও তার মাও এখন সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ। বর্তমানে প্রায় ছয়টি রোগীর এ বি ও ইনকম্পিটিবল কিডনি সংযোজন সাফল্যজনকভাবে করা হয়েছে।
প্রতিস্থাপনের শর্ত
কিডনি প্রতিস্থাপনের কিছু শর্ত রয়েছে। ইচ্ছে করলেই যে কারো কিডনি কেউ দান করতে পারেন না। এ জন্য এইচএলএ টিস্যু টাইপিংয়ের যথেষ্ট মিল থাকতে হয়। সাধারণভাবে রক্তদান আর কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রাথমিক নিয়ম অনেকটা একই।
যাঁরা দান করতে পারবেন
কারো কিডনি বিকল হয়ে গেল, কিন্তু নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি দাতা মিললেও রক্তের গ্রুপ এবং টিস্যু টাইপিং মিলছে না। এমন ব্যক্তিরা চাইলে এই পদ্ধতিতে কিডনি দান করতে পারবেন। এ জন্য রক্তের গ্রুপ মিল হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শারীরিক অন্যান্য বিষয়ও দেখা হয়।
খরচাপাতি
প্রচলিত পদ্ধতিতে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের খরচের চেয়ে এবিও-ইনকম্পিটিবল ট্রান্সপ্লান্টেশন (এবিওআই) পদ্ধতিতে খরচ বেশি হয়। কিডনি প্রতিস্থাপনের সাধারণ খরচের সঙ্গে আরো কয়েক লাখ টাকা বেশি লাগে কিছু প্রক্রিয়া ও ব্যয়বহুল ওষুধপত্রের জন্য। কিডনি ফাউন্ডেশনে এই ট্রান্সপ্লান্টের ক্ষেত্রে খরচ পড়েছিল আট লাখ টাকার মতো। তবে ব্লাড গ্রুপ মিল থাকলে সে ক্ষেত্রে কিডনি সংযোজনের খরচ লাগে মাত্র দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা। বর্তমানে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে প্রায় ৫০০ রোগীর কিডনি সংযোজন সাফল্যভাবে সম্পন্ন হয়েছে, যার ৯০ শতাংশ এখনো সুস্থ আছে।
ঝুঁকি নেই তেমন
স্বাভাবিক ট্রান্সপ্লান্ট রোগীদের মতো এই পদ্ধতিতেও ইনফেকশন ও কিডনি রিজেকশন (প্রত্যাখ্যান) ছাড়া অন্য কোনো ঝুঁকি নেই। বরং বিশ্বের অন্যান্য স্থানে বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের ১৫ বছর পরও ‘এবিওআই’ রোগীরা সুস্থ রয়েছেন। তবে ‘এবিওআই পদ্ধতিতে খরচ বেশি হয়। প্রতিস্থাপনের পর অন্যান্য ট্রান্সপ্লান্ট রোগীর মতোই তাদের বিশেষ ফলোআপের মাধ্যমে যেতে হয়।
ধরন
সাধারণত দুইভাবে এবিওআই পদ্ধতিতে কিডনি প্রতিস্থাপন চালু রয়েছে বিশ্বে। একটি হলো প্লাজমাফেরেসিস আর অন্যটি গ্লাইকোসর্ব।
প্লাজমাফেরেসিস : এই পদ্ধতিতে রক্তের প্লাজমাকে (রক্তরস) রক্তকোষ থেকে আলাদা করা হয়। একটি ছাঁকনির মাধ্যমে বারবার ছেঁকে সেখান থেকে অ্যান্টিবডিগুলো আলাদা করে দেওয়া যায় এই পদ্ধতিতে। আমরা কিডনি ফাউন্ডেশনে এই পদ্ধতিতেই ছয়টি ট্রান্সপ্লান্ট সম্পন্ন করেছি এবং আরো একটি করতে যাচ্ছি।
গ্লাইকোসর্ব : এটিও অ্যান্টিবডির ছাঁকনি যন্ত্র। তবে এর জন্য রক্ত থেকে প্লাজমা আলাদা করার দরকার হয় না। গ্রহীতার রক্ত ওই যন্ত্রের মধ্য দিয়ে একবার চালান করলেই ছাঁকনির মতো অ্যান্টিবডিগুলো পৃথক করে নেয়।
আর এই অ্যান্টিবডি আলাদা করতে পারার জন্যই অন্য রক্তের গ্রুপের কিডনি প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকে না।
সম্ভাবনার কথা
দেশে প্রায় দুই কোটি লোক কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রতিবছর সম্পূর্ণভাবে কিডনি বিকল হয় প্রায় ৪০ হাজার রোগী মারা যায়। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে ৯৫ শতাংশ হেমো ডায়ালাইসিস ও দুই থেকে আড়াই শতাংশ সিএপিডি ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে বেঁচে থাকে। তবে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ক্ষেত্রে ডোনার সংকট বেশ প্রকট। এই সংকটের মধ্য দিয়েই এ পর্যন্ত বাংলাদেশে দুই হাজারের বেশি বোগীর কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সম্পন্ন হয়েছে, যাদের সবাই জীবিত এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে নেওয়া।
বাংলাদেশে কিডনি পাচারচক্রের কথা অনেকেই অবগত, যা অত্যন্ত গর্হিত একটি কাজ। এই পাচারচক্র কিডনি দাতা ও গ্রহীতাদের বাংলাদেশের বাইরে কিডনি সংযোজন করার জন্য প্রলুব্ধ করে থাকে এবং রোগীদের পার্শবর্তী দেশে নিয়ে গিয়ে কিডনি সংযোজন করে থাকে। বাংলাদেশে নিকটাত্মীয় ছাড়া এ ধরনের গর্হিত কাজ করা হয় না এবং কিডনি দাতা বা ডোনার সংকটের সুযোগ নিচ্ছে এই চক্রটি। আধুনিক ‘এবিওআই’ পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়মিত হলে রোগীর সঙ্গে ডোনারের রক্তের গ্রুপেরও মিল থাকার দরকার হবে না। আমরা আশা করছি, এতে বেড়ে যাবে কিডনি দাতার সংখ্যা, সমাধান হবে ডোনার সংকটের, কমে যাবে কিডনি বেচা-কেনার মতো অবৈধ ও গর্হিত কাজ। সর্বোপরি এটা হবে দেশের স্বাস্থ্যখাতে বড় ধরনের অর্জন। এ জন্য দরকার ব্যাপক সচেতনতা। সূত্র কালের কণ্ঠ।