ধর্ম ও জীবন

রোজার জরুরি কয়েকটি মাসয়ালা

দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পবিত্র মাহে রমজানের ফরজ রোজা আদায় করছেন। কিন্তু কি কারণে রোজার পবিত্রতা নষ্ট হয়, কি কারণে রোজা ভঙ্গ হয় এবং কি কারণে ভঙ্গ হয় না, তা অনেকের কাছে অজানা। এ নিবন্ধে রোজা সংশ্লিষ্ট জরুরি কিছু মাসায়ালা নিয়ে আলোকপাত করা হলো।

রমজান মাসে তারাবির নামাজ ২০ রাকাত পড়া প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুন্নতে মুয়াক্কাদা। অনেকে রোজা রাখেন ঠিক, কিন্তু তারাবির নামাজ পড়তে অলসতা করেন।

এই রমজানে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষায় আলেমসমাজ এবং সরকারি নির্দেশনা মেনে ঘরেই তারাবি আদায় করুন। সম্ভব হলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘরেই জামাতে নামাজ আদায় করুন।

তারাবির নামাজের রয়েছে অশেষ ফজিলত। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রাতের (তারাবি) নামাজ ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের নিয়তে পড়বে, তার জীবনের আগের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বোখারি ২৪১৬)।

যেসব কারণে রোজা ভঙ্গ হয়না

১. অনিচ্ছাকৃত বমি হলে (মুখ ভরে হলেও) রোজা ভঙ্গ হবে না। তেমনি বমি কণ্ঠনালীতে এসে নিজে নিজে ভেতরে ঢুকে গেলেও রোজা ভাঙবে না। (তিরমিজি: ১/১৫৩)

২. স্বপ্নদোষ হলে, শরীর থেকে রক্ত বের হলে, শিঙ্গা লাগালে (রক্ত দিলে) রোজা ভঙ্গ হবে না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তিনটি বস্তু রোজা ভঙ্গ করবে না: বমি, সিঙ্গা লাগানো ও স্বপ্নদোষ। (ফিকহুস সুনানি ওয়াল আসার: ১২৯১)

তবে রক্ত দিলে যদি শরীর দুর্বল হয়ে যায়, এতে রোজা মাকরূহ হবে; কিন্তু রোজা ভঙ্গ হবেনা। (বোখারি ১৯৪০)

অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি রোজাদার অবস্থায় অনিচ্ছাবশত বা বাধ্য হয়ে বমি করবে, তার কাজা করতে হবে না। (আবু দাউদ: ১২৯৪)

৩. সুরমা, কাজল, সুগন্ধি ইত্যাদির দ্বারা রোজার কোন ক্ষতি হয় না। আনাস ইবনু মালিক (রা.) রোজাদার অবস্থায় সুরমা ব্যবহার করতেন। (ফিকহুস সুনান: ১৩০৫)

৪. মশা, মাছি, ধুলাবালি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃতভাবে গলা বা পেটে ঢুকে গেলে রোজা ভাঙবে না। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘কারো গলায় মাছি ঢুকে গেলে রোজা ভঙ্গ হবে না।’ (ইবনু আবি শায়বা, আল মুসান্নাফ: ৬/৩৪৯)

৫. ভুলে কিছু পানাহার করলে রোজা ভঙ্গ হবেনা। হাদিসে এসেছে, ‘যে রোজাদার ভুলে পানাহার করলো, সে যেন তার রোজা পূর্ণ করে; কেননা আল্লাহই তাকে পানাহার করিয়েছেন। (মুসলিম: ১১৫৫)

৬.শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোজা ভঙ্গ হবে না। (আবদুর রাযযাক, আল মুসান্নাফ: ৪/৩১৩)

৭. রোজা অবস্থায় অজ্ঞান, বেহুঁশ বা অচেতন হলে রোজা ভাঙবে না। (সুনানুল কুবরা: ৪/২৩৫)।

৮. রোজা অবস্থায় মিসওয়াক (কাঁচা বা পাকা ডাল যাই হোক) করলে রোজার কোন সমস্যা নেই। এমনকি ইফতারের পূর্বে করলেও অসুবিধা নেই। (বোখারি : ১/২৫৯)।

৯. নাইট্রোগ্লিসারিন-জাতীয় ইনহেলারে রোজা ভাঙবে না, তবে ভেনটোলিন ইনহেলারে রোজা ভেঙে যাবে, কারণ এর কিছু অংশ খাদ্যনালীতে প্রবেশ করে।

১০. নাকে ড্রপ, স্প্রে ব্যবহারের পর তা যদি গলার ভিতরে চলে যায়, তবে রোজা ভেঙে যাবে। অবশ্য গলায় না গেলে বা স্বাদ অনুভূত না হলে রোজা ভাঙবে না। (মাজাল্লাতু মাজমা‘ইল ফিকহিল ইসলামী : ২/৪৫৪)

১১. খাবার ঠিকঠাক আছে কি না তা বোঝার জন্য ঘ্রাণ নিলে রোজা ভাঙবে না। ইবনু উসাইমীন (রহ.) বলেন, খাবারের স্বাদ গ্রহণ করলে রোজা ভাঙবে না। যদি গিলে ফেলা না হয়। (রমজান মাসের ৩০ আসর, পৃষ্ঠা: ১৫৫)

১২. রোজা অবস্থায় নখ বা চুল কাটতে কোনো সমস্যা নেই। মেয়েরা হাতে-পায়ে মেহেদী দিলেও রোজার কোনো ক্ষতি হবে না।

১৩. সহবাস ছাড়া স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলে রোজা ভাঙবে না। তবে বীর্যপাত হওয়া যাবে না। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজাদার অবস্থায় (স্ত্রীকে) চুমু খেতেন এবং আলিঙ্গন করতেন। তবে, নিজ আবেগ-উত্তেজনার উপর তার নিয়ন্ত্রণ ছিলো তোমাদের সবার চেয়ে বেশি। (ফিকহুস সুনান: ১২৯৫)

১৪. রাতে সহবাস করতে কোনো অসুবিধা নেই। এমনকি সহবাসের পর গোসল না করে সেহরি খেয়ে ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার পর গোসল করলেও সমস্যা নেই। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এই কাজটি সাব্যস্ত আছে। (ফিকহুস সুনান: ১৩০৪)

১৫. গরমের কারণে, শরীর ঠাণ্ডা করতে একের অধিকবার গোসল করতেও সমস্যা নেই। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এই কাজটির প্রমাণ আছে। (আবু দাউদ: ২৩৬৫)

১৬. চোখ বা কানের ড্রপ দেয়া। ১৭. ইনহেলার বা অক্সিজেন গ্রহণ। ১৮. মিসওয়াক, টুথব্রাশ বা পেস্ট ব্যবহার অথবা দাঁত ফিলিং করা। তবে এক্ষেত্রে কোনো কিছু গিলে ফেলা পরিহার করতে হবে।

১৯. দেহের কোনো অংশে ক্যাথেটার কিংবা ক্যামেরা প্রবেশ করানো যদিওবা তা মুখ দিয়েও হয়। কেননা তা পানাহার কিংবা এর বিকল্প কিছু নয়।

২০. ক্রিম, তেল, মেকআপ, লিপস্টিক, ঠোঁট আর্দ্রকারী দ্রব্য, সুগন্ধি ব্যবহার।

২১. মুখের লালা কিংবা সর্দি গিলে ফেলা। ২২. কিছু হৃদরোগের ওষুধ/স্প্রে আছে যা জিহবার নিচে রাখা হয়, এ ধরনের ওষুধের কোনো অংশ গিলে না ফেললে তা মুখে রাখা সাওম ভঙ্গকারী নয়।

২৩. রক্ত পরীক্ষা করা। ২৪.চোখে সুরমা লাগানো। ২৫. স্বপ্নদোষ হওয়া। ২৬. দাত হতে রক্ত বাহির হওয়া। ২৭. জুনবী তথা নাপাক অবস্থায় সাহরি খাওযা। ২৮. চোখে ওষুধ লাগানো।

যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হয়

১. মুখে থুথু জমা করে গিলে ফেলা। ২. টুথপেস্ট দিযে দাত ব্রাশ করা। ৩. কয়লা মাজন দ্রব্য দিয়ে দাত মাজা।

৪.নাপাক অবস্থায় গোসল ছাড়া সারাদিন থাকা। ৫. স্ত্রীর সাথে হাসি টাট্টা করা যাতে সহবাস বা বির্যনির্গত হওয়ার আশঙ্কা হয়।

৬. রোজা রাখা অবস্থায় গোনাহের কাজ করা। ৭.অযথা কোন জিনিস চিবানো। ৮. গিবত করা। ৯. চুগোলখোরী করা।

১০.অশ্লীল কথাবার্তা বলা। ১১. সিঙ্গা লাগানো।

যেসব কারণে রোজা কাযা কাফফারা উভয়টি ওয়াজিব

১. রোজা রাখা স্মরণ অবস্থায় কোন পানাহার করা। ২. ইচ্ছাকৃত স্ত্রীর সাথে সহবাস করা। এমতাবস্থায় কাযা ও কাফফারা উভয়টি ওয়জিব।

মুসাফির অসুস্থ ব্যক্তির রোজা

কোন ব্যক্তি সফরে থাকলে (মুসাফির) এবং অসুস্থ হলে, রোজা রাখলে অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা এমতাবস্থায় রোজা ছাড়ার অনুমতি দিয়েছে ইসলাম। কিন্তু মুসাফির এবং অসুস্থ ব্যক্তিরা পরবর্তী সময় রোজা কাজা আদায় করবেন। অসুস্থ এবং মুসাফিরের জন্য রোজা রাখা বাধ্যতামূলক নয়। (সূরা বাকার:১৮৫)।

দিনের বেলায় কোন কাফের যদি ইসলাম গ্রহণ করেন কোন বালক-বালিকা যদি প্রাপ্ত বয়স্ক হন এবং কোন পাগল যদি ভালো হয়ে যায় তাহালে তারা রোজার হুকুমের আওতায় এসে যাবেন এবং সুর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত তাদেরকে পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে আগের রোজাগুলোর কাজা করা তাদের জন্য বাধ্যতামুলক নয়।

যেহেতু আগেরগুলোতে তাদের উপর রোজা ওয়াজিব ছিল না।

মহান আল্লাহতায়ালা রোজার মাসায়ালা জেনে যথার্থভাবে রোজা রাখা এবং পবিত্র রমজান মাসকে যথাযথ ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে কাটিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: এহসান বিন মুজাহির, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মুহতামিম, সাইটুলা, ইসলামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম মাদরাসা, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার। সূত্র যুগান্তর

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eleven + 9 =

Back to top button