র্যাব প্রহরায় জেসমিন হাসপাতালে, ফুটেজ নিয়ে অনেক প্রশ্ন
র্যাব হেফাজতে নওগাঁ ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে একাধিক কমিটি কাজ করছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে একজন সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করছে ২০ দিন ধরে।
অপরদিকে র্যাব সদর দপ্তর থেকে গঠিত তদন্ত কমিটিও ঘটনার পর থেকে কাজ করে যাচ্ছে। কোনো কমিটির কাজই এখনো শেষ হয়নি। তবে এরই মধ্যে র্যাবের একটি গাড়ি থেকে সুলতানা জেসমিনকে অসুস্থ অবস্থায় ধরাধরি করে হাসপাতালে নেওয়ার একটি ফুটেজ সামাজিক যোগাযাগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যা নিয়ে অনেকের মনে পুরোনো প্রশ্ন নতুন করে জনিম্ন নিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই ফুটেজে সুলতানা জেসমিনের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল-এমন আশঙ্কার কথা বলছেন অনেকেই।
ফুটেজে দেখা যায়, র্যাবের দুজন নারী সদস্য গাড়ি থেকে নামিয়ে জেসমিনকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যান। কিন্তু জেসমিন হাঁটতে পারছিলেন না। বারবার ঢলে পড়ে যাচ্ছিলেন।
হাসপাতালের ভেতরে নেওয়ার পর একটি বেঞ্চে ঢলে পড়েন জেসমিন। এ সময় তার শরীর এবং মাথা এলিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাকে পাহারায় রয়েছেন র্যাবের নারী সদস্যরা। তারা বেঞ্চ থেকে তুলে জেসমিনকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এমনকি তাকে হাসপাতালের ট্রলিতে তুলতে চাইলেও নিস্তেজ হয়ে পড়ায় তাতেও তুলতে পারছেন না।
ফুটেজের দৃশ্য অনুযায়ী, অনেকটা নিস্তেজ অবস্থায় সুলতানা জেসমিনকে লম্বা করে ট্রলিতে শুইয়ে নিয়ে ওখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ইমতিয়াজ আহমেদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলমান। তদন্তাধীন বিষয়ে তেমন কিছু বলা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্তের স্বার্থেই ঘটনার পরপর ১১ র্যাব সদস্যকে পত্যাহার করা হয়। তারা এখন র্যাব সদর দপ্তরে ন্যস্ত আছেন।
সুলতানা জেসমিনকে র্যাবের গাড়ি থেকে নামানোর পর তার শারীরিক অবস্থার যে দৃশ্য (ভিডিও) ভাইরাল হয়েছে, সে বিষয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই তদন্তকাজ চলছে।
২২ মার্চ সকাল ১০টার দিকে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় এলাকা থেকে রাজশাহী র্যাব-৫-এর একটি দল মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে সুলতানা জেসমিনকে (৪৫) আটক করে। পরে শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই নারীর মৃত্যু হয়।
সুলতানা জেসমিন সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অফিস সহকারী পদে চাকরি করতেন। জেসমিনকে র্যাব আটকের পরদিন রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। প্রতারণার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাটি করেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্মসচিব) এনামুল হক। পরে তিনি দাঁড়িয়ে থেকে জেসমিনকে র্যাবের হাতে তুলে দেন। এমনকি তার মৃত্যুর পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার আসামি করেন।
সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর পর বিষয়টি তদন্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রতিবেদন পাঠান রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার। ওই তদন্তে শুধু যুগ্মসচিব এনামুল হকের বক্তব্য ছিল। যে কারণে তা কর্তৃপক্ষের কাছে গৃহীত হয়নি। স্পর্শকাতর এ বিষয়টি তদন্তে দায়িত্ব দেওয়া হয় অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ইমতিয়াজ হোসেনকে। তিনি তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আগেই ৫ এপ্রিল সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় উচ্চ আদালত থেকে বিষয়টি তদন্তে উচ্চপর্যায়ের কমিটির গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এর আগে জুডিশিয়াল ইনকুয়ারি চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন অ্যাডভোকেট মনোজ কুমার ভৌমিক। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব উল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন।
আদালত কমিটিতে নওগাঁর জেলা জজ ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকেও অন্তর্ভুক্ত করতে বলেন। আদালতের ওই আদেশের কপি পাওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ৩ মে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে। তবে ভূমি মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে কোনো প্রতিনিধি নেওয়া হয়নি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মো. মাহমুদুল হোসাইন খানকে কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। এছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক কমিটিতে নওগাঁর জেলা ও দায়রা জজ এবং নওগাঁর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অপরদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের একজন করে দুজন প্রতিনিধি, নওগাঁর জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও নওগাঁর সিভিল সার্জনকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এই কমিটিও তাদের তদন্তকাজ দ্রুত শেষ করতে চায়। এমনটিই জানালেন কমিটির একজন সদস্য।