লকডাউনে অন্য এক মে দিবস
করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে এসেছে এবারের মে দিবস, যখন সংক্রমণ এড়াতে শ্রমজীবী মানুষকে থাকতে হচ্ছে কর্মহীন, ঘরবন্দি অবস্থায়।
ধৈর্য্য আর সাহসের সঙ্গে সবাইকে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সরকারের পাশাপাশি শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিকদেরও তিনি শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলেছেন।
‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, সোনার বাংলা গড়ে তুলি’ – এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে শুক্রবার দেশে মে দিবস পালিত হচ্ছে বাংলাদেশে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রতি বছর নানা আয়োজনের মধ্যে দিনটি পালন করলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।
ভাইরাসের বিস্তার রোধে অন্য অনেক আয়োজনের মত মে দিবসের সব আনুষ্ঠানিকতাও এবার বাতিল করা হয়েছে। জনসমাগম হয়- এমন কর্মসূচি না নিতে শ্রমিক সংগঠনগুলোকে অনুরোধ করেছেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান।
১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে হে মার্কেটের শ্রমিকরা শ্রমের ন্যায্য মূল্য এবং আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ করার দাবিতে ধর্মঘট শুরু করেছিল। সেই আন্দোলন দমনে শ্রমিকদের ওপর গুলি চালানো হয়। ১০ শ্রমিকের আত্মত্যাগে গড়ে ওঠে বিক্ষোভ। প্রবল জনমতের মুখে যুক্তরাষ্ট্র সরকার শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর শ্রমিকদের সংগ্রামী ঐক্যের অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস ঘোষণা করা হয়। ১৮৯০ সাল থেকে সারাবিশ্বে শ্রমিক সংহতির আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে মে মাসের ১ তারিখে ‘মে দিবস’ পালিত হচ্ছে।
এবারের মে দিবসের আগে ‘শ্রমজীবী মেহনতি ভাই বোনদের’ শুভেচ্ছা জানিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এক বার্তায় বলেছেন, “করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সবার আগে।”
নতুন এই করোনাভাইরাস অত্যন্ত ছোঁয়াচে বলে সব ধরনের জনসমাগম এড়িয়ে সবাইকে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্বের নিয়ম মেনে অন্তত তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে। গত ২৬ মার্চ থেকে অফিস-আদালতের পাশাপাশি যানবাহন চলাচলও বন্ধ রেখেছে সরকার।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে এর আগে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, স্বাধীনতা দিবস ও বর্ষবরণের সব আয়োজনও বাতিল করা হয়।
এই সঙ্কটে গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে বিশ্বের মেহনতি মানুষ। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন আইএলও বলেছে, মহামারীর মধ্যে লকডাউনের কারণে কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় বিশ্বে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ১৬০ কোটি শ্রমিকের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। এই কর্মীসংখ্যা বিশ্বের মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক।
বাংলাদেশ সরকার এই সঙ্কট মোকাবেলায় ইতোমধ্যে রপ্তানি খাতের শিল্পকারখানার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, যা ব্যয় হবে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে। এই সময়ে কাওকে যেন চাকরিচ্যুত করা না হয়, সে বিষয়েও সতর্ক করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতির বাণী
মে দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মানুষকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
এক বাণীতে তিনি বলেছেন, মে দিবস সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য ও সংহতির মহান প্রতীক। শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষই দেশের উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যেই নিহিত রয়েছে দেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।
দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা ও শ্রমিকদের নিরাপত্তাসহ শ্রমিকের স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন, “সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। … বঙ্গবন্ধু সেই স্বপ্ন পূরণে শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে সবাইকে দলমত নির্বিশেষে একাত্ম হতে হবে। এই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে শ্রমিক-মালিক সম্প্রীতি দেশের উন্নয়নের পথকে ত্বরান্বিত করবে বলে আমার বিশ্বাস।”
রাষ্ট্রপতি বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়াল থাবা আঘাত হেনেছে। এর ফলে গভীর সঙ্কটে পড়েছে শিল্প-প্রতিষ্ঠানসহ দেশের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ।
“এ পরিস্থিতিতে সরকার জনগণের পাশে থেকে ত্রাণকাজ পরিচালনাসহ সর্বাত্মক কাযক্রম নিয়েছে। আমি সরকারের পাশাপাশি শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিকগণকেও শ্রমজীবী মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।”
সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেও সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
রাষ্ট্রপতি বলেন, “এ সঙ্কট শীঘ্রই কেটে যাবে, ইনশাআল্লাহ। আমি ধৈর্য্য ও সাহসের সাথে সবাইকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে একযোগে পরিস্থিতি মোকাবিলার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির পথে – মহান মে দিবসে এ প্রত্যাশা।”
প্রধানমন্ত্রীর বাণী
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের মেহনতি মানুষের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সবাইকে মে দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এক বাণীতে তিনি বলেছেন, “সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন শোষিত, বঞ্চিত, মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত, একদিকে শোষক, আরেকদিকে শোষিত- আমি শোষিতের পক্ষে’। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৭২ সালে শ্রমনীতি প্রণয়ন করেন।”
বর্তমান সরকার দেশের শ্রমজীবী মানুষের জীবন-মান উন্নয়ন ও কল্যণে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের এ সকল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সুফল শ্রমজীবী মানুষ পেতে শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে লাগসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার এবং উন্নত ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর।”
করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষাপটে শ্রমজীবী মানুষের জন্য সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “শ্রমিকদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য আমরা শ্রমিক কল্যাণ গঠন করেছি। আমরা করোনাভাইরাসের অভিঘাত মোকাবিলায় দেশের রপ্তানি খাতের শ্রমিকদের বেতন দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছি।”
মে দিবসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রমিক এবং মালিক উভয়ই সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে কল-কারখানার উৎপাদন বাড়াতে আরও নিবেদিত হবেন বলেও আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সূত্র বিডি নিউজ