লালমনিরহাটের বর্বরতা যেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্বরতার প্রতিচ্ছবি (ভিডিওসহ)
যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হেফাজতে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের “আমি শ্বাস নিতে পারছি না”—এই বাক্য এখন মানুষের মুখে মুখে। ধিক্কার-নিন্দার-প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে পুরো বিশ্ব।
লালমনিরহাটের মমিনুল ইসলামের কাহিনিও কোথায় যেন ফ্লয়েডের সঙ্গে মিলে যায়। বৃদ্ধ-অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য অটো (শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ইজি বাইক) থেকে দুই লিটার তেল চুরির দায়ে ১৮ বছর বয়সী এই তরুণ গত মঙ্গলবার সকালে লালমনিরহাটের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির বেধড়ক মারধরের শিকার হন।
নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে গতকাল মমিনুল বলেন, “হাতে টাকা নেই, বাড়িতে মা অসুস্থ, তাই অটো (ইজি বাইক) থেকে দুই লিটার তেল নিয়েছিলাম। অটোর চালক আমাকে ধরে দুটি থাপ্পড় মেরে ছেড়ে দেন। এরপর এক মুরব্বি এসে আমাকে আবারও আটকে রড দিয়ে পিঠে বাড়ি দেন। গলার ওপর পা তুলে দেন। আমি অনেক হাত-পা ধরেছি, কিন্তু কথা না শুনে তিনি মারধর করতে থাকেন। আর দু-তিন মিনিট হলে আমি ওখানেই মারা যেতাম।”
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, মমিনুলের বর্ণনার চেয়েও অনেক বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। কিন্তু ভয়ে আতঙ্কে বিপর্যস্ত থাকায় পুরোটা বলতে পারেননি। মমিনুল লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের ইটাপোতা গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় হোটেল শ্রমিক।
আর মমিনুল যে ‘মুরব্বি’র বিরুদ্ধে এ অভিযোগ এনেছেন তিনি শহরের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একজন, আশরাফ আলী লাল (৬০)। জেলা ট্রাক ও ট্যাংক লরি মালিক সমিতির সভাপতি আশরাফের মালিকানাধীন সীমান্ত শপিং কমপ্লেক্সের নিচতলায় অমানবিক এ নির্যাতন চালিয়েছেন তিনি। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে বাড়ি থেকে আশরাফ আলীকে আটক করে পুলিশ।
এর আগে ওই দিন রাত ১০টার দিকে একজন ব্যবহারকারী ফেসবুকে নির্যাতনের ভিডিওটি আপলোড করার পর তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে (ভাইরাল হয়)। এর পরপরই পুলিশ অভিযানে নামে। পরে নিজ বাড়ি থেকে উদ্ধার করে থানায় নেওয়া হয় মমিনুলকে। গতকাল বুধবার তিনি আশরাফ আলীসহ অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনের বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা করেছেন। আদালতের মাধ্যমে আশরাফ আলীকে জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ।
ভিডিওটিতে দেখা যায়, আশরাফ আলী মমিনুলকে বারবার মেঝেতে ফেলে বেধড়ক মারধর করছেন। কয়েকজন তাঁকে সহায়তা করছেন, কেউ কেউ শুধুই দর্শক। জুতা পরিহিত আশরাফ কখনো ওই তরুণের মাথা-কান, কখনো গলা পা দিয়ে চেপে ধরছেন। একসময় তাঁকে মাটিতে ফেলে মুখে লাথি মারেন, একাধিকবার জুতা পায়ে গলা চেপে ধরেন আশরাফ। মমিনুল আশরাফের হাত-পা ধরে ছেড়ে দেওয়ার যত আকুতি জানান তত তাঁর ওপর নির্যাতন বাড়ে। পাশে থাকা একজন ‘না মেরে পুলিশে দেওয়ার’ পরামর্শ দিলেও তাতে কান দেননি আশরাফ।
ভিডিওতে অন্য এক ব্যক্তির পা ধরেও কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করতে দেখা যায় মমিনুলকে। এ সময় আশরাফের উদ্দেশে বারবার মমিনুল বলছিলেন, ‘চাচা, ছেড়ে দেন, আমাকে মাফ করে দেন। আমি আর কোনো দিন এ কাজ করব না। বাড়িতে আমার বুড়া মা আছে।’ কিন্তু আশরাফ তাতে থামেননি। একসময় আশরাফ মমিনুলকে ছেড়ে দিয়ে দোকানে ঢুকে গেলে অন্যরা তাঁকে মারধর করতে থাকে।
লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা জানান, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া নির্যাতনের ভিডিও দেখে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে পুলিশ অভিযানে নেমে প্রথমে প্রধান অভিযুক্তকে আটক করে। পরে রাতভর খুঁজে মমিনুলকে নিজের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে থানায় নেয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত বাকিদেরও চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে।