আইন ও বিচার

শিপ্রার মামলা নেয়নি কক্সবাজার সদর থানা

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অপপ্রচারের অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শিপ্রা দেবনাথের করা ফৌজদারি অভিযোগ আমলে নেয়নি কক্সবাজার সদর থানা পুলিশ। তাঁকে কক্সবাজারের রামু থানা অথবা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খায়রুজ্জামান। এমনটি জানিয়েছেন শিপ্রার আইনজীবী মাহবুবুল আলম টিপু।

সাতক্ষীরা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোস্তাফিজুর রহমান ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এসপি মিজানুর রহমান শেলীসহ অজ্ঞাত দেড়শ জনের বিরুদ্ধে মামলা করতে গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সদর থানায় যান নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সহযোগী ও রাজধানীর স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিপ্রা দেবনাথ।

এর আগে ব্যক্তিগত ছবি ফেসবুকে পোস্টকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে এক ভিডিওবার্তায় ঘোষণা দিয়েছিলেন শিপ্রা দেবনাথ। শিপ্রা ভিডিওতে বলেন, ‘আমি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অষ্টম সেমিস্টারে অধ্যয়নরত এবং ফ্রিল্যান্সার মিডিয়া কর্মী। আজ একটি নৃশংস ঘটনা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে চাই।’

শিপ্রা বলেন, ‘পুলিশ বাহিনী আমাদের গর্ব। অথচ ৩১ জুলাই রাতে এই বাহিনীর কুখ্যাত ওসি প্রদীপ ও তাঁর সহচর পরিদর্শক লিয়াকত মেজর সিনহাকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করেন।’

পুলিশের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ডিভাইস নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করে শিপ্রা বলেন, ‘মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর রাতে এসে আমাদের কটেজ থেকে পুলিশ দুটি মনিটর, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ক্যামেরা, লেন্স, তিনটি হার্ডড্রাইভ এবং আমাদের ফোনসহ সব ডিভাইস নিয়ে যায়। জব্দ তালিকায় যার কোনোটির কোনো উল্লেখ নেই। আমি জানি না, এখন কীভাবে বা কার কাছে সেসব ফেরত চাইব।’

শিপ্রা আরো বলেন, ‘আমাদের পারসোনাল প্রোফাইল ও ডিভাইস থেকে বিভিন্ন ছবি চুরি করে কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাই ফেসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন। আমার নামে খোলা হয়েছে ভুয়া ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম আইডি। আমার ব্যক্তিজীবনকে যাঁরা অসহনীয় করে তুলেছেন বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও তৈরির মাধ্যমে, তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আমি তথ্যপ্রযুক্তি আইনে যথাযথ ব্যবস্থা নেব, কথা দিলাম।’

শিপ্রা প্রশ্ন রাখেন, ‘আমাকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করে এভাবে আমার ব্যক্তিগত জীবনকে নিগৃহীত করার প্রচেষ্টা বাংলাদেশের আইনে কি শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়? আমি সমস্ত পুলিশ বাহিনীকে দায়ী করছি না। এখানে অনেক সৎ কর্মকর্তা রয়েছেন। কিন্তু এরূপ হত্যাকারী কর্মকর্তা এবং একজন নারীকে সামাজিক মাধ্যমে বিকৃতভাবে উপস্থাপনকারী অসুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন কিছু পুলিশ সদস্যকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় না আনা হলে এই কলঙ্কের দায়ভার জাতি সম্পূর্ণ বাহিনীর ওপর ন্যস্ত করবে।’

শিপ্রা দেবনাথ আরো বলেন, ‘একজন মানুষ হত্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আমার টুঁটি চেপে ধরে আমাকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিলে লাখো তরুণ-তরুণী এর প্রতিশোধ নেওয়া থেকে নিশ্চয়ই বিরত থাকবে না।’

এ ভিডিওবার্তা ছাড়ার একদিনের মাথায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করতে সদর থানায় যান শ্রিপা। সেখানে মামলাটি না নিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

শিপ্রার আইনজীবী মাহবুবুল আলম টিপু বলেন, ‘ওসি বলেছেন ঘটনাস্থল সদর থানা এলাকায় নয়। তাই মামলাটি এ থানায় নথিভুক্ত করা যাবে না। ইলেকট্রনিকস ডিভাইসগুলো রামু এলাকায় খোয়া গিয়ে থাকলে সে থানায় গিয়ে মামলা করা যাবে বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি চাইলে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলাটি করতে পারেন।’

শিপ্রা ওসিকে জানান, পুলিশের মামলায় জামিন পাওয়ার পর থেকে তাঁর  বসবাস সৈকত এলাকার জলতরঙ্গ রিসোর্টে। তা সদর থানার আওতায়। এ কারণে তিনি সদর থানায় মামলা করতে এসেছেন। এরপরও ওসি মামলাটি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে সদর থানার ওসি মো. খায়রুজ্জামান ও পরিদর্শক মাসুম খানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। উভয়ের মুঠোফোনে রিং হলেও ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

এদিকে শিপ্রা দেবনাথের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করা দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে রিট হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মনোজ কুমার ভৌমিক গত রোববার হাইকোর্টে এই রিট করেন। জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের ফেসবুক পোস্টের ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে রিটে।

শিপ্রার ছোট ভাই শুভজিৎ কুমার দেবনাথ বলেন, ‘পুলিশের উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কিছু লোক শিপ্রার ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি ও উসকানিমূলক কথাবার্তা ফেসবুকে ছড়িয়ে চরিত্র হননের অপচেষ্টা চালাচ্ছে।’

সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান গত ১৪ আগস্ট শিপ্রার ব্যক্তিগত কিছু মুহূর্তের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে তাঁর নির্দোষ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেন। এ রকম আরো ছবি আসার ব্যাপারেও ইঙ্গিত দেন তিনি। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের এসপি মিজানুর রহমান শেলীও অনুরূপ পোস্ট দিয়েছেন। শিপ্রার কিছু ছবি পোস্ট করে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া মামলার যথার্থতার পক্ষে নিজের অবস্থানের কথা ফেসবুকে তুলে ধরেছেন।

এই পোস্টগুলোতে যেসব মন্তব্য এসেছে, তার অনেকগুলোই ছিল শিপ্রার জন্য অবমাননাকর। অধীন কিছু পুলিশ কর্মকর্তাকেও সেখানে এসপির পক্ষে মন্তব্য করতে দেখা গেছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত কিছু ফেসবুক গ্রুপ, যেমন : ‘পুলিশই জনতা, জনতাই পুলিশ’, ‘স্যালুট টু বিডি পুলিশ’ এ রকম কিছু গ্রুপেও ছবিগুলো পোস্ট করা হয়েছে।

গত ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ সময় সিনহার সঙ্গে থাকা সিফাতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরা যে নীলিমা বিচ রিসোর্টে ছিলেন, সেখানে অভিযান চালিয়ে পুলিশ শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নূরকে আটক করে। পরে তাহসিন রিফাত নূরকে অভিভাবকের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়। শিপ্রা দেবনাথকে রামু থানায় করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। আর সিফাতকে টেকনাফ থানায় করা হত্যা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার দুটি মামলা ও রামু থানায় করা মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। সিফাত, শিপ্রা ও তাহসিন বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। তাঁদের নিয়ে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য কক্সবাজারে প্রামাণ্যচিত্র তৈরির কাজ করছিলেন।

৯ আগস্ট শিপ্রা ও ১০ আগস্ট সিফাতের জামিন মঞ্জুর করেন কক্সবাজারের আদালত। পরে তাঁরা জামিনে মুক্তি পান।

সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে গত ৫ আগস্ট কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এতে নয়জনকে আসামি করা হয়। আসামিরা হলেন টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ, টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত হওয়া পরিদর্শক লিয়াকত আলী, উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, পুলিশ কনস্টেবল সাফানুর রহমান, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, মো. মোস্তফা ও এসআই টুটুল। এঁদের মধ্যে আসামি মোস্তফা ও টুটুল পলাতক। বাকি সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। এ ছাড়া পুলিশের করা মামলার তিন সাক্ষী এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের তিন সদস্যকে সিনহা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। এ নিয়ে সিনহা হত্যা মামলায় ১৩ জন গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে র‍্যাবের রিমান্ডে রয়েছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 + 8 =

Back to top button