‘শেষ সময় আম্মার পাশে থাকতে না পারার আফসোস যাবে না’
জীবন থেমে থাকে না। বাবা (জিল্লুর রহমান) রাষ্ট্রপতি হলেন। পরিবারে নতুন বিয়ে, নতুন শিশুর আগমন, কত কত খুশির ঘটনা। নানা উৎসবের উপলক্ষ আসে মাঝেমধ্যে। হাসি, আনন্দের দেখা মেলে। কিন্তু মুহূর্তেই তা উবে যায়। মন খারাপেরা ভর করে। হুট করেই মনে পড়ে যায় শূন্যতার কথা, হারানোর ব্যথা। উৎসবে সবাই আসে এক ছাদের নিচে, শুধু একজন ছাড়া। তিনি আমার আম্মা, আইভি রহমান। তাঁর অমন নির্মমভাবে চলে যাওয়ার দুঃসহ স্মৃতিরা এভাবেই ফিরে ফিরে আসে।
আম্মা একাধারে রাজনীতি, নারী আন্দোলন ও সামাজিক বিভিন্ন কাজে সক্রিয় ছিলেন। শুধু নামে নয়, সব সংগঠনেই ছিল তাঁর সোচ্চার উপস্থিতি। দিনরাত ব্যস্ততায় পার করেছেন। তবু কখনো তাঁকে পরিবার থেকে দূরে মনে হয়নি। পরিপাটি, সাজানো সংসার ছিল আমাদের। আমাদের তিন ভাইবোন ও বাবার সবকিছু গুছিয়ে রাখতেন মা। বিয়ের পর আলাদা সংসার হয় আমাদের। কিন্তু সপ্তাহে একাধিকবার দেখা হতো। সবার ওপর সব সময় ছায়া হয়ে থাকতেন মা। সেই ছায়া সরে গেল ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট, চিরতরে।
আম্মা কখনোই কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন না। ২১ আগস্ট সকালে আয়করের একটি চিঠি পেয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা নিয়ে ফোন করেন। যদিও দুশ্চিন্তার মতো কোনো চিঠি ছিল না। এরপর বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ভাইয়া (নাজমুল হাসান পাপন) ফোন করলেন।
বললেন, ‘আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলা হয়েছে, আব্বা-আম্মার খোঁজ নাও।’ মা-বাবার বাসায় ফোন করে জানলাম, দুজনেই সমাবেশে গেছেন। এরপর ভাইয়াকে ফোন দিতেই তাঁর কান্নার আওয়াজ পেলাম। অনেক মানুষ আহত হওয়ার খবর পেলাম। এতেও তেমন বিচলিত হইনি। টিয়ার গ্যাস বা পুলিশের লাঠিচার্জ ভেবেছি। কিন্তু ভাইয়ার কান্না শুনে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। ছয়টার কিছুটা পরে রেহানা আপার (শেখ রেহানা) মেয়ে রূপন্তী ফোন করে বলল, ‘পাপন কাকাকে শিগগিরই ঢাকা মেডিকেলে যেতে বলো।’ তখন মনে হলো খারাপ কিছু ঘটেছে।
আমি বের হয়ে মা-বাবার বাসায় গেলাম। বাবা সমাবেশ থেকে ফিরেছেন। বিধ্বস্ত চেহারা, পাঞ্জাবি রক্তে লাল হয়ে আছে। দুই বোন মিলে দ্রুত আব্বার সারা শরীর ভালো করে দেখলাম। কোথাও তেমন জখম নেই দেখে আশ্বস্ত হলাম। কেউ একজন তাঁকে গাড়ি করে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেছেন। কিন্তু আব্বা কারও কথা বুঝতে পারছেন না, বমি করেছেন একবার। বারবার বলছেন, ‘তোমার আম্মার খবর নাও।’
এরপর চারদিক থেকে খবর আসা শুরু হলো, সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়েছে। চমকে গেলাম। গ্রেনেড হামলার কথা আগে কখনো শুনিনি।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ভাইয়া ফোন করে জানাল, এখনই কাউকে জানানোর দরকার নেই, আম্মার পা দুটো কেটে ফেলা হয়েছে। একটি ট্রলির ওপর রেখেই করা হয় এ অপারেশন। উপস্থিত চিকিৎসকেরা কোনোরকমে এটি করেছেন। ভাইয়াকে শুধু জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাঁচবে তো?’ উত্তর এল, ‘বাঁচবে, চিন্তা কোরো না।’
আম্মাকে দ্রুত কোনো হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়ার চেষ্টা চলছে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হলো। আমরা দুই বোন সাড়ে আটটার দিকে জাহাঙ্গীর গেটে গেলাম। অনেকক্ষণ পর ঢুকতে দিল। এর আগে আম্মার অ্যাম্বুলেন্সও এখানে আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়েছে। এরপর চিকিৎসা শুরুর আগে অনুমতির জন্য আরও অপেক্ষা করতে হয়েছে আম্মাকে। আর আমাদের দুই বোনকে আবার আটকানো হলো সিএমএইচের গেটে। আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষার পর রাত ১১টায় ভেতরে ঢুকতে পারলাম। আম্মা তখন অপারেশন থিয়েটারে। ধীরে ধীরে স্বজন ও দলীয় নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে এখানে আসতে থাকেন। তাঁরা মিলে ৬৩ ব্যাগ রক্ত দেন আম্মাকে। আমরা তিন ভাইবোন, ভাবি ও খালার পরিবারের কয়েকজন সিঁড়িতে বসে ছিলাম। খালাতো ভাই তারেক আহমেদ সিদ্দিকও (এখন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা) গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে এখানে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ভোর সাড়ে চারটায় আম্মাকে বের করে পোস্ট অপারেটিভ রুমে রাখা হলো। শুধু ভাইয়া একবার ঢুকে আম্মাকে দেখে এসেছে। আমাদের কারও দেখা হয়নি। স্বচ্ছ কাচের বাইরে থেকে শুধু লাল কম্বলে মোড়া আম্মার অবয়ব দেখেছি।
তখন হাসপাতালে আর থাকার সুযোগ নেই। দ্রুত আমরা আব্বার কাছে ফিরে এলাম। আগের রাতে আব্বাকে জানিয়েছিলাম, আম্মা সামান্য আহত হয়েছেন। রাতেই আব্বার শোয়ার ঘরের টিভির সংযোগ খুলে রেখেছি। সকালে সংবাদপত্র সরিয়ে ফেলেছি। পরদিন পত্রিকায় আম্মার রক্তভেজা ছবি দেখলাম, রাস্তায় অসহায় হয়ে বসে থাকা সেই ছবি। ওই দিনের ছবি দেখেই ভয়াবহতা প্রথম আঁচ করতে পারি। বিরাট ধাক্কা খাই, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এমন যুদ্ধক্ষেত্র কেন!
২২ আগস্ট একজন একজন করে আম্মাকে দেখার সুযোগ পেলাম। দুই থেকে তিন মিনিটের জন্য। এর চেয়ে বেশি দাঁড়াতে দিত না। শুধু বলত, ‘চলে যান, চলে যান।’ দিনের মধ্যে কয়েকবার ভাইবোনেরা ভাগ করে এভাবে দেখেছি। পুরো শরীর ঢাকা থাকলেও ডান হাতটা বের হয়ে ছিল। ওই হাতও কালো হয়ে যাচ্ছিল। তাই কেটে ফেলতে হবে বলে জানালেন চিকিৎসকেরা। তবু চাইতাম আম্মা ফিরে আসুক। আবার মনে হতো, স্বাধীনচেতা আম্মা কি এভাবে বেঁচে থাকতে চাইবেন?
২৩ আগস্ট আব্বাকে সত্যিটা জানানোর পর বললেন, ‘তোমার আম্মা এভাবে বাঁচতে চাইবেন না।’ ওই দিন বাইরে থেকে চিকিৎসক আনার অনুমতি দেয় সিএমএইচ। কিডনি বিশেষজ্ঞ হারুন অর রশীদকে ডেকে আনেন ভাইয়া। তিনি জানান, পরিস্থিতি ভালো নয়। এ কারণে আব্বাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আব্বা দেখে এসে সন্ধ্যায় বললেন, ‘তোমার আম্মার শরীর গরম, জ্বর আসছে মনে হয়।’ শুনে আমরা কিছুটা স্বস্তি পাই, গরম তো ভালো লক্ষণ।
সেই স্বস্তি বেশিক্ষণ টিকল না। রাত দুইটার দিকে ভাইয়া ফোন করে জানাল, আম্মা আর নেই। পরিবারের সম্মতি ছাড়াই ভেন্টিলেশন খুলে নিয়েছে হাসপাতাল। তারও দুই ঘণ্টা পর জানিয়েছে ভাইয়াকে। ২৪ ও ২৫ আগস্ট হরতাল ছিল। তাই ভেন্টিলেশনে রাখার অনুরোধ করা হয় কিন্তু তারা রাখেনি। সিএমএইচ জানিয়েছে, পরিবার অনুমতি দিলে সকালে তারাই দাফন করে দেবে। আর না হলে তার আগে মরদেহ নিয়ে যেতে। তৎকালীন সরকার চাইছে বনানীতে দ্রুত দাফন করে দিতে। দলও লাশ নিতে চাইছে। আব্বা জানালেন, লাশ নিয়ে কোনো মিছিল হবে না। এরপর সকালে ভাইয়া হাসিনা আপাকে (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) ফোন করে দুপুরের পর হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাহার করা হয়। মরদেহ প্রথমে বাসায় এবং পরে বায়তুল মোকাররমে নেওয়া হয়। এরপর বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আম্মাকে হারিয়ে শিশুদের মতো কেঁদেছেন আব্বা, অসম্ভব ভালোবাসতেন। ২০১৩ সালে আব্বাও চলে গেলেন। আম্মাকে নিয়ে আমাদের আফসোস কিছুতেই যায় না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, সিএমএইচে না নিয়ে বিএসএমএমইউতে নিলে হয়তো ভালো হতো। চিকিৎসা শুরু করতে এতটা দেরি হতো না। অন্তত আমরা একটু বেশি সময় আম্মার পাশে থাকতে পারতাম। সিএমএইচের চিকিৎসক, কর্তৃপক্ষ বা তৎকালীন সরকার ঠিকই জানত আম্মা বাঁচবে না। তবু আমাদের পাশে যেতে দেয়নি। শেষ সময়ে আমাদের খবর দেয়নি। একটু বেশি সময় আম্মার পাশে থাকতে দিলে কী ক্ষতি হতো; শুধু কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতাম। ভেন্টিলেশন খোলার আগে জানালেও শেষ সময়ে আমরা পাশে থাকতে পারতাম। কিন্তু এতটুকু সহানুভূতি দেখানো হয়নি আমাদের। যত দিন বেঁচে থাকব, আমাদের তিন ভাইবোনের এ আফসোস কখনো যাবে না।
তানিয়া রহমান: আইভি রহমানের মেয়ে (প্রথম আলো)