Lead Newsকরোনাভাইরাস

সেরামের টিকা অনিশ্চিত; যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন থেকে আনার উদ্যোগ

করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার বেড়েছে ভারতে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। দেশটিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ লাখেরও বেশি মানুষ এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্বে এই প্রথম কোনও দেশে একদিনে এত বেশি মানুষ আক্রান্ত হলেন। অপরদিকে মারা গেছে ২ হাজারের বেশি মানুষ। খবর এনডিটিভির

বৈশ্বিক এই মহামারি থেকে বাঁচতে ভ্যাকসিনই এখন বড় অবলম্বন। ভারতে টিকাদান উৎসবের শুরুর দিকে ভ্যাকসিন গ্রহণে অনাগ্রহ থাকলেও এখন আগ্রহ বেড়েছে সেদেশের জনগণের। এ চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বিশ্বে ভ্যাকসিনের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভ্যাকসিন রপ্তানি আগেই বন্ধ করে দিয়েছে ভারত সরকার। কবে নাগাদ তা চালু হবে সে বিষয়েও কিছু বলা হচ্ছে না। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন কার্যক্রম চলছে সেরামের উৎপাদিত কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি এ ভ্যাকসিন সেরাম থেকে কিনে আনছে বাংলাদেশ সরকার। এ ছাড়া কোভ্যাক্সের মাধ্যমে যে ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা তারও বড় অংশ আসবে এই সেরাম ইনস্টিটিউট থেকেই। সামনে কবে ভ্যাকসিনের পরবর্তী চালান পাওয়া যাবে এটি এখন অনিশ্চিত। সরকার ইতিমধ্যে তিন কোটি ডোজের চুক্তি করে অগ্রিম অর্থও জমা দিয়ে রেখেছে। এমতাবস্থায় চুক্তির ভ্যাকসিন সেরাম কবে দেবে তার নিশ্চিত কোনো তথ্য মিলছে না।

টিকা আনার ক্ষেত্রে এই অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় এখন দ্রুত নতুন উৎস খুঁজছে সরকার। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন থেকে টিকা আমদানির উদ্যোগে বাড়তি জোর দিয়েছে সরকার।

টিকা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত একটি কমিটি গতকাল বুধবার বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, রাশিয়ার স্পুতনিক-ভি ও চায়না সিনোফার্ম ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনের টিকা আমদানির প্রস্তুতি হিসেবে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে ইতিবাচক মত দিয়েছে। টিকার বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া প্রস্তাব পরীক্ষা করে কার্যকারিতা ও দামের বিষয়ে মতামতসহ সুপারিশ করতে ১৯ এপ্রিল এই কোর কমিটি গঠন করেছিল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। আট সদস্যের কমিটির প্রধান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, কমিটি গতকাল ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠিত তাদের প্রথম বৈঠকে পাঁচটি টিকা নিয়ে আলোচনা করে। এর মধ্যে দুটি টিকা নিয়ে তারা আগ্রহ দেখায়নি। একটি হলো চীনের সিনোভ্যাকের টিকা, যার কার্যকারিতা ৫০ শতাংশেরও কম। অন্যটি যুক্তরাষ্ট্রের জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা, যা কমপক্ষে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। এটা বাংলাদেশের জন্য কঠিন।

ভারত টিকা রপ্তানির বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার খবর আসার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অন্য উৎস খতিয়ে দেখতে কমিটিটি গঠন করেছিল। কমিটিকে মতামতসহ সুপারিশ পাঠাতে সাত দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ফলে কমিটির সদস্যদের হাতে সময় আছে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত। প্রথম বৈঠকের পর কাল শুক্রবার কমিটির পরবর্তী বৈঠক ডাকা হয়েছে।

টিকা আমদানি করতে চায় রেনাটা

এদিকে বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার টিকা আমদানি করতে চায় সুপরিচিত ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রেনাটা লিমিটেড। এ জন্য তারা সরকারের অনুমোদন চেয়েছে। গত মঙ্গলবার রেনাটার পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দেওয়া এক চিঠিতে বলা হয়, মডার্নার টিকার কার্যকারিতা ৯৪.৫% এখন পর্যন্ত এটিই একমাত্র টিকা, যার কোনো গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এই টিকা সংরক্ষণও অনেক বেশি সুবিধাজনক।

চিঠিতে আরও বলা হয়, মডার্নার টিকা করোনাভাইরাসের যুক্তরাজ্য ধরন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা দেখিয়েছে। রেনাটা মডার্নার টিকা আমদানির অনুমতি চেয়ে আরও বলেছে, তারা বাংলাদেশের বাজারে এই টিকা সহজলভ্য করতে চায়। সরকার চাইলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরবরাহ করতেও আগ্রহী। মডার্নার সঙ্গে টিকার বিষয়ে তারা যোগাযোগ রক্ষা করে আসছে।

তিন কোটি ডোজ দিতে আগ্রহী রাশিয়া

রাশিয়ার টিকার বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্যসেবা সচিব লোকমান হোসেন মিয়াকে একটি জরুরি চিঠি দেন। এতে তিনি বলেন, রাশিয়ার কাছ থেকে স্পুতনিক-ভি টিকা সংগ্রহের চেষ্টা তাঁরা অব্যাহত রেখেছেন। রাশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সেখানকার ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি অব রাশিয়ান ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বা সিআরডিআইএফ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাঁরা বাংলাদেশকে আগামী মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৪০ লাখ, সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ কোটি ও ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৩ কোটি ৬০ লাখ ডোজ টিকা দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। টিকার বিষয়ে তথ্য পাওয়া ও চুক্তি করতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

এর আগে পররাষ্ট্রসচিব ১২ এপ্রিল আরেক চিঠিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে জানিয়েছিলেন, রাশিয়া স্পুতনিক-ভি টিকা বাংলাদেশে পাঠানো, এ দেশে উৎপাদন ও ব্যবহারের বিষয়ে কিছু তথ্য জানতে চায়। তাদের জানতে চাওয়া বিষয়ের মধ্যে ছিল বাংলাদেশে টিকার চাহিদা কত এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠান টিকা উৎপাদনে সক্ষম।

এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ রাশিয়ার টিকা আমদানি ও উৎপাদনে সক্ষম প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। তারা তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে মতামত চায়—স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (বিএমআরসি)।

এর মধ্যে ১৩ এপ্রিল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে সম্ভাব্য প্রতিষ্ঠানের নাম পাঠান। তাঁদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশের জন্য স্বল্প মেয়াদে প্রায় ৩ কোটি ডোজ ও দীর্ঘ মেয়াদে ১৪ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন। সরকারি সংস্থাগুলোই এই টিকা আমদানি করতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশে টিকা উৎপাদন করতে পারবে ওষুধ কোম্পানি ইনসেপ্টা লিমিডেট, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যাল ও হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদনের অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এরা প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে স্পুতনিক-ভি টিকা এক থেকে দুই মাসের মধ্যে উৎপাদনে যেতে পারবে।

এ ছাড়া বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, রেনাটা লিমিটেড ও এক্মি ফার্মাসিউটিক্যালস টিকা উৎপাদনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপনে সক্ষম। অবকাঠামো প্রস্তুত করতে তাদের আনুমানিক এক বছর সময় লাগবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে জানিয়েছে, দেশের জন্য স্বল্প মেয়াদে ছয় কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন। টিকা কেমন হওয়া দরকার, এ বিষয়ে কিছু গুণগত মানের কথাও উল্লেখ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে জানিয়েছেন, তাঁদের এ বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে পারছেন না।

সব উপায় খুঁজতে হবে’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা মোজাহেরুল হক বাংলাদেশের প্রথমসারির একটি পত্রিকাকে বলেন, ‘ভারত ছাড়াও রাশিয়া বা চীন থেকে সরকার এখন যে টিকা আনার চেষ্টা করছে, তা আরও আগেই করা উচিত ছিল। আমাদের যখন চীন টিকা দিতে চেয়েছিল, তখন তাদের সঙ্গে চুক্তি করতে পারতাম, গবেষণায়ও অংশ নিতে পারতাম।’ তিনি বলেন, সব পথ খোলা রাখা উচিত ছিল। সেটা কাজে লাগালে আজকে যে সমস্যাটা দেখা দিয়েছে, তা এড়ানো যেত। জনগণ আশ্বস্ত থাকত।

মি. হক আরও বলেন, দেশের সাড়ে ১২ কোটি মানুষের জন্য টিকা লাগবে ২৫ কোটি ডোজ। সরকারকে টিকা নিশ্চিত করতে যত রকমের উপায় আছে, তা খুঁজে নিতে হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fifteen + 15 =

Back to top button