হংকংয়ে বাকস্বাধীনতার মৃত্যু
হংকংয়ে বাকস্বাধীনতার মৃত্যু
হংকংয়ের পত্রিকা অ্যাপল ডেইলি অনেকটা জোর করেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেদিন পত্রিকাটি বন্ধ করা হয়, সেদিন মানুষ লাইন ধরে এর সর্বশেষ কপি কিনেছেন। ওই দিন পত্রিকাটি ছাপা হয়েছিল ১০ লাখ কপি। গত বছর চীনের কমিউনিস্ট সরকার যখন হংকংয়ের ওপর জাতীয় সুরক্ষা আইন নামে কঠোর আইন জারি করে, তখন থেকেই এই কাগজের ওপর খড়্গ নেমে আসে। পুলিশ পত্রিকাটির অফিসে অভিযান চালায়। সাংবাদিকদের মারধরের হুমকি দেয়। পত্রিকাটির সম্পদ জব্দ করা হয়। তারা দীর্ঘদিন কর্মীদের আর বেতন দিতে পারে না। সংবাদপত্রটির জ্যেষ্ঠ সম্পাদক এবং প্রধান কলাম লেখককে গ্রেপ্তার করা হয়।
পত্রিকাটির বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগ হচ্ছে, ‘বিদেশি শক্তির সঙ্গে যোগসাজশ’। হংকংয়ের সাবেক প্রধান নির্বাহী সি ওয়াই লিউং অত্যন্ত নির্বোধভাবে যেমনটা বলেছেন, ‘বিদেশি শক্তির সঙ্গে যোগ দিয়ে পত্রিকাটি নোংরামি করছে’। পত্রিকাটির সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে ১৯৯৫ সালে জিমি লাই এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, হংকং সরকার, দুর্নীতিগ্রস্ত স্থানীয় ধনকুবের ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে কড়া ভাষায় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করা। লাই এক বছর ধরে কারাগারে বন্দী আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জালিয়াতি, বিদেশের সঙ্গে যোগসাজশ ও বেআইনি বিক্ষোভে অংশ নেওয়া। তত্ত্বীয়ভাবে তাঁকে এভাবে আজীবন বন্দী রাখা যেতে পারে।
উচ্চ মানসিকতার প্রগতিশীল কাজকর্মের সঙ্গে লাই কিংবা তাঁর কাগজের আদর্শ খাপ খায় না। অ্যাপল ডেইলি একটি সংবেদনশীল ট্যাবলয়েড পত্রিকা। এটি চলচ্চিত্র জগতের তারকা ও অন্যান্য স্থানীয় সেলিব্রিটিদের অবাধ যৌনাচার, লাম্পট্যের গালগল্প ও সাধারণ কৌতুক দিয়ে ভর্তি থাকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশির ভাগ উদার গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের প্রকাশনাগুলোকেই বাক্স্বাধীনতার অধিকারের জন্য সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলোর কথা বলা যায়। এরা খুব একটা প্রগতিশীল, উচ্চমনস্ক কিংবা নীতিনৈতিকতাসম্পন্ন নয়।
তবে অ্যাপল ডেইলির নিজস্ব কিছু নীতিনৈতিকতা ছিল। সত্য হচ্ছে পত্রিকাটি জনপ্রিয় ধাঁচের ছিল এবং সর্বদা রুচিশীল ছিল না। তবে অ্যাপল ডেইলি এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে তুখোড় কিছু প্রতিবেদন করেছিল। এটি ছিল হংকংয়ের একমাত্র পত্রিকা, যারা নিয়মিতভাবে দুর্নীতি, অর্থ কেলেঙ্কারি বা রাজনৈতিক অন্যায়-অবিচারগুলো প্রকাশ করত ও বিশ্লেষণ করত।
লাই একজন আকর্ষণীয় ও জটিল ব্যক্তিত্বের মানুষ। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের গুণগ্রাহী এবং ধর্মান্তরিত ক্যাথলিক। লাইকে বলা যেতে পারে এক কঠিন হীরা। ১৯৫৯ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি চীন থেকে পালিয়ে হংকং গিয়েছিলেন। তারপর মাত্র ৩০ বছরের
কম সময়ের মধ্যে তিনি একটি পোশাক কারখানার শিশু শ্রমিক থেকে ‘টেক্সটাইল ম্যাগনেট’ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর জিনস কাপড়ের ব্র্যান্ডের নাম জিওর্দানো। চীনসহ সমগ্র এশিয়ায় এটি প্রচুর বিক্রি হয়। ফলে তিনি প্রায় রাতারাতি ধনী হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৮৯ সালে চীনে গণতন্ত্রপন্থীদের ব্যাপক বিক্ষোভের পর লাইয়ের সবকিছু বদলে যেতে থাকে। তিনি তিয়েনআনমেন স্কয়ারে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন এবং তাদের বিনা মূল্যে টি-শার্ট দেন। বিক্ষোভ দমনে চীনা শাসক যখন সৈন্যসামন্ত পাঠায় এবং হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে মেরে ফেলে, তখন লাই কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর পোশাক ব্যবসা বিক্রি করে দেন। শুরু করেন নেক্সট নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করতে। এরপর শুরু করেন অ্যাপল ডেইলি। তিনি বলেন, আমার কাছে তথ্যই হলো স্বাধীনতা।
১৯৮৯ সালে যিনি বর্বরোচিত অভিযান চালিয়েছিলেন, সেই লি পেংকে ‘নির্বোধ’ ও ‘কচ্ছপের ছেলে’ সম্বোধন করে নিবন্ধ লিখেছিলেন লাই। গুজব ছিল যে তাঁর বাবা হত্যাকাণ্ডে মারা যাওয়ার পর লিকে দত্তক নিয়েছিলেন ঝাউ এনলাই। লি অবশ্য এই দাবিকে অস্বীকার করেছেন। সরকার লাইকে ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘দুর্বৃত্ত’, ‘পচা আপেল’ ইত্যাদি বলে নিন্দা জানিয়েছে। হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থী রাজনীতিবিদদের তাঁর সমর্থন এবং ১৯৮৯ সালের স্মৃতিকে তিনি যেভাবে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন, তা সরকারের জন্য বিপজ্জনক ও ধ্বংসাত্মক বলে মনে করে হংকং সরকার।
লাই শারীরিকভাবেও বিপদের মুখে ছিলেন। হংকংয়ে তাঁর বাড়িতে বোমাবর্ষণ করা হয়েছিল। তাঁকে অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তিনি সব সময়ই নজরদারিতে ছিলেন এবং তিনি যেখানেই যেতেন, সেখানেই তাঁকে অনুসরণ করা হতো।
লাই কখনোই হাল ছাড়েননি। তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণহত্যার স্মরণে প্রতিবছর সেখানে উপস্থিত হতেন। তিনি গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিতেন। হংকংয়ের স্বাধীনতা ধরে রাখার জন্য তিনি ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র সফরে যেতেন এবং তাদের সমর্থন আদায় করতেন। ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন লাই মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এ জন্য তাঁকে উপহাস করা হয়েছিল। তবে তিনি ডেমোক্রেটিক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তাঁর ট্যাবলয়েড পত্রিকাটি তারকাদের নিয়ে নানা গালগল্প প্রকাশের পাশাপাশি গুরুতর রাজনৈতিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করত। এটি ছিল হংকংয়ের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অপরিহার্য কণ্ঠস্বর।
এখন এই কণ্ঠস্বর থেমে গেছে। লাই কারাগারে ধুঁকে মরছেন। তাঁর সঙ্গে আরও অনেকে আছেন, যাঁরা হংকংয়ের নাগরিকদের লেখার ও কথা বলার অধিকার, আইনের শাসন এবং নিজেদের স্বৈরশাসকের পক্ষে ভোট দেওয়ার অধিকার আদায়ের চেষ্টা করতেন। তাঁদের রাজনীতি ভীষণ বৈচিত্র্যময়। মার্টিন লি একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যারিস্টার এবং উদার গণতন্ত্রপন্থী, জশুয়া ওং এক তরুণ উদীয়মান বামপন্থী এবং লাই একজন ট্রাম্প প্রশংসিত রক্ষণশীল খ্রিষ্টান। তারপরও তাঁরা পরস্পরের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
যখন স্বাধীনতা জিম্মি দশায় থাকে, তখন মানুষ ছোট ছোট পার্থক্যগুলোকে মেনে নিতে পারে না, যে পার্থক্যগুলো দেশের উদার রাজনীতিকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। দেশের মানুষ মনে করে, গণতন্ত্রকে সহজভাবে মেনে নেওয়া যেতেই পারে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● ইয়ান বুরুমা দ্য চার্চিল কমপ্লেক্স: দ্য কার্স অব বিয়িং স্পেশাল, ফ্রম উইনস্টন চার্চিল অ্যান্ড এফডিআর টু ট্রাম্প অ্যান্ড ব্রেক্সিট বইয়ের লেখক