স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা

হার্টের চিকিৎসায় ভ্রান্তির শিকার রোগীরা

মানবদেহের হৃদপিণ্ডের ধমনিতে ব্লকজনিত সমস্যার কারণে ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কার্ডিওথোরাসিক সার্জারির (ইএসিটিএস) পক্ষ থেকে এতদিন ধরে যে চিকিৎসার সুপারিশ করে আসছিল সেটি তারা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

হার্ট বা হৃদপিণ্ডের ব্লকজনিত সমস্যার চিকিৎসায় তারা ওপেন হার্ট সার্জারির তুলনায় ধমনিতে স্টেন্ট বসানোর সুপারিশ করেছিল। অথচ স্টেন্ট প্রস্তুতকারক বহুজাতিক সংস্থার স্বার্থে বিস্তর ‘জল মেশানো আছে’ অভিযোগ এনে তারা সেটি প্রত্যাহার করে।

আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের ‘বাইবেল’ খ্যাত এ প্রতিষ্ঠানের সুপারিশে ভর করে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসকরা রোগীদের চিকিৎসাও দিয়েছেন। আর সংস্থাটির ভুল সুপারিশে প্রতারণার কিংবা ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন বিশ্বের সাধারণ রোগীরা। যদিও ইএসিটিএস বলছে, এক্সেল নামের বিখ্যাত সমীক্ষায় ভর করে বছরখানেক আগে ওই সুপারিশ করা হয়েছিল, সূত্র জাগো নিউজ।

মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) সুপারিশটি প্রত্যাহার করা হয়। সোমবার (৯ ডিসেম্বর) রাতে সুপারিশ প্রত্যাহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় ইএসিটিএস কাউন্সিলে।

ইএসিটিএস-এর মহাসচিব ডোমেনিকো প্যাগানো সংস্থার ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেন, ‘বিষয়টি গভীর উদ্বেগের। আমাদের সংস্থার ভুল সুপারিশে এরমধ্যে না-জানি কত রোগীর ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। এক্সেল-এর সমীক্ষায় তথ্য গোপন করা হয়েছিল বলেই এই গণ্ডগোল।’

হৃদরোগ ও হৃদ-শল্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন কিংবা ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ কার্ডিয়োথোরাসিক সার্জারির মতো সংস্থাকে প্রায় ‘বাইবেল’-জ্ঞানে মানা হয় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা ক্ষেত্রে। তাদের পর্যবেক্ষণ, মতামত ও সুপারিশ অক্ষরে অক্ষরে মানতে চেষ্টা করেন গোটা বিশ্বের চিকিৎসকরা।

২০১০ থেকে মার্কিন মুলুকের দুই হাজার রোগী নিয়ে চালানো এক্সেল সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছিল, বাঁ দিকের মূল হৃদ-ধমনি ব্লক হয়ে গেলে স্টেন্ট বসানোয় কোনো সমস্যা নেই। সে সমীক্ষা প্রকাশিত হয় বিজ্ঞান পত্রিকা নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে। এরপরই ওপেন হার্ট সার্জারির পক্ষে পুরোনো সুপারিশ থেকে সরে স্টেন্ট বসানোর সুপারিশ করে ইএসিটিএস।

কিন্তু সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি নিউজনাইট ইনভেস্টিগেশন জানায়, স্টেন্ট নির্মাতা বহুজাতিক সংস্থার টাকায় তথ্য গোপন করা হয়েছে এক্সেল সমীক্ষায়।

এক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সমীক্ষকদের বানানো নয়া সংজ্ঞায় দেখা গিয়েছিল, বাঁ দিকের মূল হৃদ-ধমনি ব্লকেজের শিকার রোগীর বুকে স্টেন্ট বসানো অথবা ওপেন হার্ট সার্জারি দুইটার মধ্যেই তেমন ফারাক নেই। কেননা, অপারেশনের ৩০ দিন থেকে এক বছরের মধ্যে স্টেন্ট বসানো রোগীদের হার্ট অ্যাটাকের হার ১.৭% এবং ওপেন হার্ট সার্জারির রোগীর ক্ষেত্রে এই হার ১.১%।’

ওই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘হৃদ-ধমনি ব্লক হয়ে হার্ট নিজেই যখন রক্ত সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হয়, তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। ওরা সেটাই মানতে চায়নি। অথচ চিরাচরিত হার্ট অ্যাটাকের সংজ্ঞা ধরলে সাফ দেখা যাচ্ছে, এক্সেল সমীক্ষায় মিথ্যে তুলে ধরা হয়েছে। সমীক্ষার অপ্রকাশিত তথ্যে উঁকি মারতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, ওপেন হার্ট সার্জারির রোগীদের চেয়ে স্টেন্ট বসানো রোগীদের হার্ট অ্যাটাকের হার প্রায় ৮০% বেশি।’

এই তথ্য প্রকাশ্যে আসতেই টনক নড়ে ইএসিটিএস-এর। কেননা, তাদের বছর খানেক আগের সুপারিশ এক্সেলের বিকৃত তথ্যে ভর করেই। চিকিৎসক মহল অবশ্য বলছে, এ প্রথম নয়। এর আগেও ব্যবসায়িক স্বার্থের কাছে মাথা নুইয়েছে চিকিৎসা। ২০১৫-র সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল, অদরকারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অপারশেনের মাধ্যমে হাসপাতালের মুনাফা বাড়ানোর জন্য ম্যানেজমেন্টের তরফে ডাক্তারদের রীতিমতো ‘টার্গেট’ দেওয়ার চল রয়েছে ভারতের মতো বহু দেশে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 + 12 =

Back to top button