হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি সেরা ৫ চরিত্র
বাংলাভাষা-সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের ৭৩তম জন্মদিন আজ৷ ১৯৪৮ সালের এই দিনে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম৷ শিক্ষাজীবনে অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর রাখার পাশাপাশি সাহিত্যেও অতুলনীয় পাঠকনন্দিত তিনি৷
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের তাঁর ৬১তম জন্মদিনে বলেছিলেন, মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত লিখে যেতে চাই। লেখালেখিই আমার বিশ্রাম। লেখালেখি বন্ধ হলে আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে পড়বে, আমি বাঁচতে পারবো না। পাঠকদের উদ্দেশে তার আবেদন ‘দোয়া করবেন, আমি যেন আমৃত্যু লিখে যেতে পারি।’ তার সেই আশা পূরণ হয়েছিল। নিউইয়র্কে হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও তিনি ‘দেয়াল’ উপন্যাস লিখেছেন।
‘পাখি উড়ে যায় ফেলে যায় পালক’—জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অনেক উপন্যাসেই পাওয়া যায় এই কথা। ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ নেই; কিন্তু তাঁর সৃষ্ট জনপ্রিয় চরিত্রগুলো টিকে আছে আজো। ঘুরে বেড়ায় এ শহরে-ও শহরে। সাহিত্যের পাতা থেকে মানুষের মস্তিষ্কে ঘুরে ফেরে তারা। কখনো বা চলতি পথে বাস্তবজীবনেও দেখা মেলে তাদের। এক অদ্ভুত সম্মোহনী ক্ষমতা আছে হুমায়ূন আহমেদের লেখায়।
তাই তো তাঁর সৃষ্ট কাল্পনিক চরিত্রগুলোর জন্যও তীব্র আন্দোলন করে, রাজপথে নামে মানুষ! দিন-রাত খালি পায়ে রাজপথে হেঁটে বেড়ায় তরুণরা। বাড়ির ছাদে কোনো তরুণী উদাস দৃষ্টিতে অপেক্ষার আনন্দ নেয় বিষণ্ণ চোখে! এসবই তাঁর কালজয়ী চরিত্রগুলোর প্রভাব।কোন চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যে কালের সীমা অতিক্রম করবে, তা নিয়ে চলে এই চরিত্রগুলোর মধ্যে নীরব প্রতিযোগিতা। হুমায়ূন আহমেদের সেই চরিত্রগুলো নিয়ে কথা হোক এবার।
হিমু: ‘প্রচণ্ড রোদে নিউমার্কেট এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে যুবক। হাতে একটি সিগারেট। আজ হরতাল। কখন একটি বাস পুড়বে, সেই আগুনে সে সিগারেট ধরাবে!’ এই বিস্ময়কর তরুণটিই হলো হিমু। ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম’ বইতে এভাবেই একটি ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা চরিত্রের একটি হচ্ছে হিমু। খালি পায়ে পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ায় হিমু। উদ্ভট সব কাজই তার মূল কর্মকাণ্ড। যুক্তির ধার ধারে না। এমন সব কাণ্ড করে যে তার আশপাশের মানুষ বরাবরই অবাক হয়ে যায়। মানুষকে চমকে দেওয়াই তার কাজ। তার ওপর ক্ষিপ্ত হলেও শেষ পর্যন্ত মানুষের ভালোবাসাই আদায় করে নেয় এই বিচিত্র চরিত্রটি। আর সব শেষে মানুষের কল্যাণেই তার উদ্দেশ্যহীন যাত্রাটি শেষ করে।নব্বইয়ের দশক থেকে এই ‘হিমু’ ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এ দেশের তরুণরা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ‘হিমু’ হতে চেয়ে খালি পায়ে পিচঢালা পথে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাটা নিয়েছেন অনেকে। হিমুর প্রথম বইয়ের নাম ‘ময়ূরাক্ষী’।
মিসির আলী: মোটা ফ্রেমের ভারী চশমা পরিহিত লোকটি কিছুতেই বিশ্বাস করেন না অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা। যত রহস্যময় ঘটনাই ঘটুক, যুক্তি দিয়ে তার সমাধান খুঁজে নেন। এই যুক্তিবাদী মানুষটির নাম ‘মিসির আলী’। হিমুর ঠিক বিপরীত। হিমু যেমন যুক্তি মানে না, মিসির আলী আবার যুক্তির বাইরে হাঁটেন না। হুমায়ূন আহমেদের তৈরি করা চরিত্রগুলোর মধ্যে ‘মিসির আলী’ই তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। ‘হিমু’কে যদি অগোছালো আর যুক্তিতর্কবিরোধী চরিত্রের প্রতীক বলা হয়, মিসির আলী হচ্ছে সম্পূর্ণ তার বিপরীত। মানুষের মন, আচরণ, স্বপ্ন এবং সংকট যুক্তির আলোকে ব্যাখ্যা করাই হলো মিসির আলীর একমাত্র কাজ।
শুভ্র: ‘শুভ্র’ চরিত্রটি তার নামের অর্থের মতোই শুদ্ধতম এক মানবের প্রতিচ্ছবি হয়ে ফুটেছে। হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রগুলোর মধ্যে শুভ্র অন্যতম। নিজেকে পৃথিবীর যাবতীয় জটিলতা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। দৈনন্দিন সমস্যা নিয়ে ভাবতে চায় না শুভ্র। সব সময় মোটা ফ্রেমের চশমা পরে বইয়ের মাঝে ডুবে থাকে। বাবার বিপুল সম্পত্তি শুভ্রকে কখনো টানে না। শুভ্র বেঁচে থাকতে চায় সুন্দরের শুদ্ধতা নিয়েই।
বাকের ভাই: কোনো গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটকের চরিত্র যে বাস্তবজীবনে এভাবে দৃশ্যমান হয়, তা বোধ হয় আগে কেউ দেখেনি। হুমায়ূন আহমেদই সেই বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করেন ‘বাকের ভাই’ চরিত্রের মাধ্যমে। তাঁর ‘কোথাও কেউ নেই’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয় নাটক। এ নাটকে ‘বাকের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর।পাড়ার এক মাস্তানকে একটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসি দেওয়া হয়। এরই প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে শত শত মানুষ! বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বন্ধের দাবিতে মিছিল, সমাবেশ, বিক্ষোভ হয়। নাটকের স্ক্রিপ্ট ঘোরানোর কথা বলা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফাঁসিই বহাল রেখেছেন নাট্যকার। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হওয়ার পর কেঁদেছিলেন মানুষ। এমনকি নাট্যকারের ওপর তীব্র অভিমান থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে! নাটকজগতের সে এক বিস্ময়কর ইতিহাস ‘বাকের ভাই’ চরিত্রটি।
রূপা: হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি সৃষ্টি ‘রূপা’। ‘হিমু’র মতো এক বাউণ্ডুলেকে ভালোবাসে এই অসম্ভব রূপবতী মেয়েটি। সব সময় অপেক্ষা করে হিমুর পথের দিকে তাকিয়ে। হিমু ফোন দিয়ে বলে, ‘রূপা আমি আসছি।’ হিমুর পছন্দের আকাশি রঙের শাড়ি, চোখে কাজল দিয়ে ছাদে কিংবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে রূপা। কিন্তু হিমু আসে না। রূপাও জানে, হিমু আসবে না। কিন্তু তারপরও অসম্ভব মায়া আর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে। পরিণতিহীন এক প্রেম নিয়ে রূপা দাঁড়িয়ে থাকে সব সময় হিমুর পথের দিকে তাকিয়ে।তুমুল জনপ্রিয় এসব চরিত্রের মধ্য দিয়েই ভক্তদের মাঝে বেঁচে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। বাঁচবেন আরো অনেক দিন।