Lead Newsশিল্প ও বাণিজ্য

গবাদিপশু উৎপাদনে নীরব বিপ্লব; স্থানীয় পশুতেই মিটবে কোরবানির চাহিদা

দেশে গরু-ছাগল উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। গরু ও ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে গত এক বছরে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন লাখ। সারা বছর মাংসের জোগান ও কোরবানির চাহিদা মেটানোর পর বিদেশেও রফতানি হচ্ছে গরু-ছাগলের মাংস।
অথচ পাঁচ বছর আগেও কোরবানির ঈদে বৈধ-অবৈধ পথে ভারত, নেপাল ও মিয়ানমার থেকে ২০ থেকে ২৫ লাখ গরু আমদানি করে দেশের চাহিদা পূরণ করতে হতো। সারা বছরে এই সংখ্যা ছাড়িয়ে যেত ৪০ লাখ।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চলতি বছরের কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর তথ্য বিশ্নেষণে গরু-ছাগলের এই সংখ্যা জানা গেছে। আসন্ন কোরবানি ঈদ উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার গবাদিপশুর সংখ্যা-সংক্রান্ত একটি চিঠি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
সমকালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আসন্ন ঈদুল আজহায় এবারও কোরবানির গরুর চাহিদা মেটাবে দেশি গরু। এর জন্য এক কোটি ১৭ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬৩ পশু প্রস্তুত আছে। চোরাই পথে গরু-ছাগল না এলে কোনো সংকট হবে না। এর মধ্যে গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৫ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬৩ এবং ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭২ লাখ।
সরকারি আটটি খামারে উট-দুম্বাসহ কোরবানির প্রাণী আছে আরও সাত হাজার। গত বছর কোরবানিতে জবাই হয়েছিল ১ কোটি ১৫ লাখ পশু। এর মধ্যে ছাগল-ভেড়া ছিল ৭১ লাখ, গরু ৪৪ লাখ।
দেশে গত বছরের চেয়ে গরুর উৎপাদন বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার আর ছাগল-ভেড়ার উৎপাদন বেড়েছে এক লাখ। এর আগে ২০১৭ সালে কোরবানিতে জবাই হয়েছিল ১ কোটি চার লাখ ২২ হাজার পশু। ধারাবাহিকভাবে দেশে গরু-ছাগলের উৎপাদন বাড়ছে। ২০১৮ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ঘোষণা দেয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, গবাদিপশু উৎপাদনে বিশ্বে দ্বাদশ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এককভাবে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি সায়েন্স অনুষদের শিক্ষক নূরুল ইসলাম বলেন, ‘গবেষণায় গরুর উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। গরু মোটাতাজা করে লাভবান হচ্ছেন গৃহস্থ ও ক্ষুদ্র খামারিরা। গরু লালন-পালনে বিকশিত হচ্ছে দেশের দুগ্ধশিল্পও। দেশে ডেইরি শিল্প একটি উদীয়মান শিল্প। গরু লালন-পালনের মধ্য দিয়ে দেশের তরল দুধের ঘাটতি মেটানো সম্ভব।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (খামার) ড. এবিএম খালেদুজ্জামান বলেন, ‘সীমান্ত পথে গরু আসা বন্ধ হওয়ার পর আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত হয় গরু-ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। দেশীয় গরু উৎপাদনে কয়েকটি প্রকল্প ও টিম গঠন করা হয়। নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা হয় খামারিদের সঙ্গে, প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাদের। গ্রামে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। সারা বছরই খামারিরা ভালো দাম পাচ্ছেন। ফলে কোরবানির ঈদের বাজারের শেষ দিন অনেক গরু ফেরত যাচ্ছে এখন। ভারত, মিয়ানমার এবং নেপাল থেকে গরু আমদানি নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়।
২০১৪ সালে ভারত সরকার এ দেশে গরু আসা বন্ধ করে দেয় হঠাৎ। এরপর গরু-মোটাতাজাকরণে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে আড়াই শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয় খামারিদের। ওই সুবিধা পেয়ে সারাদেশে অসংখ্য শিক্ষিত বেকার তরুণ গরুর খামার গড়ে তোলেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত খামারির সংখ্যা হচ্ছে ৫ লাখ ৭৭ হাজার ৪১৬ জন। সারাদেশে গরু-ছাগলের খামার গড়ে উঠেছে প্রায় দেড় লাখ। ফলে গরু-ছাগলের উৎপাদন বাড়ছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সম্প্রতি সারাদেশে গরু-ছাগলের চাষ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এতে একটা সাড়া পড়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে যেসব এনজিও কাজ করছে, তাদের অধিকাংশ এখন ঋণ দিচ্ছে গরু পালনে। এ খাতে বিনিয়োগ করছে ব্যাংকগুলোও। এতে গরু পালন বেড়েছে অনেক দ্রুত। চামড়াশিল্পেও রফতানি আয় বাড়ছে। বাণিজ্যিকভাবে গরু উৎপাদন ছাড়াও কৃষকরা গরু লালন-পালন করে দুধ ও বছর শেষে গরু বিক্রি করে চালাচ্ছেন সংসার। গরু-ছাগল লালন-পালন এ অঞ্চলের মানুষের আদিম পেশা। শীর্ষে রয়েছে ভারত ও চীন।’ তিনি বলেন, শুধু উৎপাদন বাড়ানো নয়। জাতগত বৈশিষ্ট্যেও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের গরুর মাংস সম্পূর্ণ হালাল। গ্রামীণ এলাকায় সামান্য আদরে বেড়ে ওঠা ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের সেরা জাত।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা ইমরান হোসেন বলেন, ‘দেশি গরুর চাহিদা বাড়ায় শিক্ষিত তরুণ ও প্রবাসীরা গবাদিপশুর খামারে বিনিয়োগ করছেন। গরু আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে এ খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে। কোরবানির হাটে ক্রেতারা দেশি গরু খোঁজেন হন্য হয়ে। তারা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মোটা করা বিদেশি গরু কিনতে চান না। ক্রেতারা লাল গরু, পাবনা-মানিকগঞ্জের গরু, উত্তরবঙ্গ ও মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমের গরু কিনতে বেশি আগ্রহী। এসব এলাকার গরুর মাংসের মান ও স্বাদ তাদের কাছে অতুলনীয় বলে জানায়। বাজারে মাংসের দাম বাড়লেও ক্রেতার অভাব নেই। সুপারশপগুলোতে সারা বছর মানসম্মত গরু ও খাসির মাংসের ব্যাপক চাহিদা থাকে।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক বলেন, ‘কোরবানির পশুর সংকট নয়, এখন কী পরিমাণ গরু অবিক্রীত থাকবে, তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কোরবানিতে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি গবাদিপশু আছে এখন দেশে।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 − fourteen =

Back to top button