খোলা জানালা

‘আমরা অমানুষ নই, আমরা পালিয়ে যাইনি’

প্রবীর রায় সম্প্রতি করোনার উপসর্গ নিয়ে নড়াইলে মারা যাওয়া বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরীর ভাইপো। তিনি বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বড়দিয়া শাখা সংসদ, নড়াইলের সাধারণ সম্পাদক। কাকার মৃত্যু নিয়ে তাঁর একটি ফেইসবুক পোস্ট বেশ আলোচিত হয়েছে। তবে লেখাটি তিনি দয়া করে পুরোটা পড়তে বলেছেন। পজিটিভ নিউজের পাঠকদের জন্য লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

আমরা অমানুষ নই, আমরা পালিয়ে যাইনি
–প্রবীর রায়–

করোনা উপসর্গ নিয়ে আমার সেজো কাকা বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রথম আলো, কালের কণ্ঠসহ কয়েকটি পত্রিকা মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেসব রিপোর্টের চটকদারিত্বে প্রলুব্ধ হয়ে অনেকেই ফেসবুকে শেয়ার করছেন, নানা মন্তব্য করছেন। আমার কাকাতো ভাইসহ আমাদের পরিবারের প্রতি নানা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া হচ্ছে। প্রিয়জন হারানোর পর আমাদের যন্ত্রণা অনেক বেড়ে গেছে। মানসিক যন্ত্রণার মধ্যেই বিভ্রান্তি কাটাতে কয়েকটা কথা লিখতে বাধ্য হচ্ছি।
‘স্বজনেরা এগিয়ে না আসায় মৃত ব্যক্তির সৎকার করলেন ইউএনও’ শিরোনামে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকায় লাশ সৎকারে স্বজনেরা কেউ এগিয়ে আসেনি।’… ‘পরিবারের লোকজন তাঁকে পৃথক একটি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করেন। গত শনিবার রাতে তিনি মারা যান। ঘরের মধ্যে তাঁর মৃতদেহ রেখে আত্মগোপনে যান স্ত্রী ও সন্তানেরা।’
‘করোনা সন্দেহে বাবার মুখাগ্নি করতে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলের অস্বীকৃতি!’ শিরোনামে ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘মরদেহ সৎকারে আসেনি কেউ। হিন্দুরীতিতে বাবার শেষকৃত্যে মুখাগ্নি করার কথা ছেলের, সেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেও আসেনি। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার চাপে বাধ্য হয়ে এসে কোনরকমে দূর থেকে আগুন দিয়েই ছুট। পরিবারের কাউকে এমনকি আপনজনরাও আসেনি।’
বর্তমান মানসিক অবস্থা কিছু লেখার অনুকূলে না থাকলেও, বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষীদের তাগাদায় মিথ্যা রিপোর্ট সম্পর্কে কিছু লিখতে হচ্ছে।
প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, আমার কাকা ৭ মে ঢাকা থেকে বাড়িতে ফেরার পথে তাঁর কাশি দেখা দেয়। জ্বর ছিল না। তাঁর কাশির সমস্যাটা মাঝে-মধ্যেই হয়। কিন্তু করোনার কথা বিবেচনায় আমার কাকাতো বোন (মেজো কাকার মেয়ে) ডা. সেতু রায়ের পরামর্শে তাঁকে আলাদা ঘরে রাখা হয় এবং করোনা পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়। ১০ মে রবিবার সকালে সেজো কাকিমা খাবার দিতে গিয়ে কাকাকে মৃত দেখতে পান। করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হওয়ায়, পরিবারের পক্ষ থেকে কালিয়ার ইউএনওকে ফোনে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি কয়েকজন সহকর্মী আর স্বাস্থ্যকর্মীকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসেন। চোরখালি শ্মশানে সৎকার-কাজে পরিবারের পক্ষ থেকে আমি প্রবীর রায় (প্রয়াতের ভাইপো), স্নেহাশিস রায় (প্রয়াতের ভাইপো), দীপ রায় (প্রয়াতের ছেলে) ও আমাদের আত্মীয় অঙ্কিত বিশ্বাস অংশ নিই। সনাতন ধর্মীয় বিধান অনুসারে প্রয়াতের ছেলে দীপ রায় মুখাগ্নি করে। সৎকার শেষ করে বিকেলের দিকে আমরা শ্মশান থেকে বাড়ি ফিরি।
না, আমরা পালিয়ে যাইনি। মুখাগ্নি করতে আমার ভাই দীপ অস্বীকৃতি জানায়নি। প্রিয়জনের মৃতদেহ ফেলে কোনো মানুষ কি পালিয়ে যেতে পারে?
‘প্রথম আলো’র রিপোর্টের শেষে ইউএনও সাহেবের বক্তব্য হিসেবে বলা হয়েছে, ‘মুখাগ্নি করার জন্য ছেলেও উপস্থিত ছিলেন।’ ‘প্রথম আলো’র কাছে আমার প্রশ্ন, ঘরের মধ্যে মৃতদেহ রেখে যদি স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা আত্মগোপনে যান, তাহলে বাবাকে মুখাগ্নি করার জন্য ছেলে উপস্থিত থাকে কী করে?
পত্রিকাগুলোর রিপোর্টের সঙ্গে যে ছবি প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানে পিপিই পরা ৪ জনকে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে একজন দীপ রায় (প্রয়াতের ছেলে), আরেকজন অঙ্কিত বিশ্বাস (প্রয়াতের আত্মীয়)।
এ কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কালিয়ার ইউএনও মো. নাজমুল হুদা সাহেবের ভূমিকা প্রশংসনীয় এবং তাঁর তত্ত্বাবধানেই আমার কাকার সৎকার হয়েছে। আমাদের পরিবার তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।
প্রিয়জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত মিথ্যা রিপোর্টের জন্য আমাদের পরিবারকে হেয়-প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে। আমাদের পরিবারের একজন হয়ে আমাদের মানসিক যন্ত্রণার বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্য সকলের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানাই।আমার ছোট ভাই (প্রয়াতের ছেলে) দীপ রায়কে কেউ কেউ ‘কুলাঙ্গার’ বলেও গালি দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর কী অপরাধ? এই গালি কি তার প্রাপ্য?
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, আমার কাকাকে আলাদা ঘরে কেন রাখা হলো। করোনার উপসর্গ দেখা দিলে তো আলাদা ঘরেই রাখার কথা। আবার কেউ কেউ বলছেন, সৎকারের জন্য প্রশাসনকে কেন আসতে হলো? এটাই তো স্বাভাবিক। করোনার উপসর্গ নিয়ে যদি কেউ মারা যায়, তবে তাঁর সৎকার তো নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে হওয়াই সংগত।
প্রথম আলো, কালের কণ্ঠের কোনো প্রতিনিধি আমাদের বাড়িতে বা শ্মশানে আসেননি। কোনো রিপোর্টেই আমাদের পরিবারের বক্তব্য আসেনি। আমাদের অভিযুক্ত করা হচ্ছে, অথচ আমাদের বক্তব্য নেই। এটা তো সাংবাদিকতার নিয়মের বাইরে।প্রথম আলোর নড়াইল জেলা প্রতিনিধি রিপোর্টটা করেছেন। আমি তাঁর অপরিচিত নই। রিপোর্ট করার আগে আমার কাছ থেকে জেনে নিতে পারতেন। আমি ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠিয়েছি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘স্বজনেরা এগিয়ে না আসায় মৃত ব্যক্তির সৎকার করলেন ইউএনও’ কিংবা ‘করোনা সন্দেহে বাবার মুখাগ্নি করতে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলের অস্বীকৃতি!’ এসব চটকদার শিরোনাম পড়ে পাঠক সহজে প্রলুব্ধ হচ্ছে।কেউ কেউ বিরূপ মন্তব্য করছেন, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তাঁদের অজানাই থেকে যাচ্ছে। আমার ছোট ভাই দীপ ও আমাদের পরিবার অপরাধ না করেও তাঁদের কাছে অপরাধী থেকে যাব! আমার বক্তব্য সবাই যে বিশ্বাস করবেন, সে আশা করি না। কেউ কেউ ভাবতে পারেন, পত্রিকায় যেহেতু এসেছে কিছুটা তো সত্য! এখন নিজেদের বাঁচানোর জন্য এসব আত্মরক্ষামূলক কথা আমি বলছি। এমন যদি কেউ ভেবে থাকেন, তাঁকে শুধু অনুরোধ করব প্রকৃত সত্য জানার জন্য প্রয়োজনীয় খোঁজ-খবর নিন। সত্য অনেক শক্তিশালী। সত্যকে আড়াল করে রাখা যায় না।
এ রকম একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট প্রকাশের ফলে সমাজে কী প্রভাব পড়ে, অভিযুক্তের ওপর দিয়ে কী ধরনের মানসিক ঝড় বয়ে যায়, সেটা উপলব্ধি করার অনুরোধ জানাই। এই রিপোর্টের সঙ্গে একটি পরিবার, একটি অঞ্চল ও একটি কমিউনিটির সম্মান-মর্যাদা গভীরভাবে যুক্ত।মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানাই। আমার বক্তব্যে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে, তার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।
বিশ্বাস করুন, “আমরা অমানুষ নই, আমরা পালিয়ে যাইনি।”
প্রবীর রায়
(প্রয়াত বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরীর ভাইপো)
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
বড়দিয়া শাখা সংসদ, নড়াইল।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 − 6 =

Back to top button