শোন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গল্প বলি
আমার একটা চাকুরি দরকার ছিল। ইন্টার্নশিপ শেষ করে নয় মাস চট্টগ্রামের ক্লিনিকে কাজ করে ঢাকা ফিরেছি। ঢাকা ফিরেই ’৯৫ সালের রেড ক্রিসেন্টের বন্যা ত্রাণ কর্মসুচিতে মেডিকেল টিমের হয়ে নওগাঁ জেলায় কিছুদিন কাজ করে এসে বেকার। ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভাল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের আন্দোলন চলছে; কিছুটা বিভ্রান্ত অবস্থায় বাসায় বসে আছি স্ত্রী-কন্যাসহ। কোনো ক্লিনিকে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে। একদিন ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে ডাক্তার লাগবে শুনে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। কিন্তু পোস্টিং হবে দক্ষিণবঙ্গের কোনো গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে; আমাকে চাকুরি শেষে কত লক্ষ টাকা প্রাপ্য হবে সেই হিসেব দেখানোর পরেও মন টানল না। এক বন্ধুর প্ররোচনায় একটা ঔষধ কোম্পানিতে চাকুরি নিয়ে গেলাম চট্টগ্রামেই। কিন্তু কাজের ধরণ দেখে ফিরে এসে তাদের ব্রিফকেস তাদেরকেই ফেরত দিয়ে এলাম। পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ইন্টারভিউ দেয়া মনস্থ করি। এখানে কথাবার্তা বলে ভাল লাগে – মাস ছয়েক সাভারে সবেতনে প্রশিক্ষণ শেষে ধানমণ্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে পোস্টিং হবে। আমি প্রস্তুতি হিসেবে বিএমএন্ডডিসির সনদ আর মোটর সাইকেল চালানোর সাময়িক লাইসেন্স সংগ্রহ করি।
১০ জুলাই ১৯৯৬ তে প্রশিক্ষণার্থী নবীন চিকিৎসক হিসেবে সাভারের নয়ারহাটের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলাম।ওখানে ঢোকা মাত্র জুলাই মাসটা হয়ে গেল আষাঢ় মাস। ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন বাংলায়, ক্যালেন্ডার বাংলা। আমার ছোট ভাই আমাকে ডাক্তারদের টিনশেড হোস্টেলে পৌঁছে দিল, আমি তখন বিবাহিত হয়েও ব্যাচেলর হিসেবে থাকব। হাসপাতালের পিছনের পথে, কিছুদিন আগেই ম্যাকর্ড সাহেব (Professor Colin Mccord, Johns Hopkins University, USA) থাকতেন এমন একটা লাল ইটের দোতলা ফাঁকা বাড়ি আর ফাঁকা জায়গা পার হয়ে ইট বিছানো ছায়া ঢাকা পথে পৌঁছতে হত গ্রামের স্কুল ঘরের মতো দেখতে সেই হোস্টেলে। আলাদা রুম পেলাম অবশ্য, তাতেই শান্তি। কেন্দ্রের ভিতরের জায়গাগুলোর আলাদা আলাদা নাম ছিল – লাল টেক, কাঁঠাল টেক ইত্যাদি। আরণ্যক পরিবেশ। আমাকে ডা. নজরুল ইসলাম খুব সাহায্য করল সবকিছু গুছিয়ে নিতে। গণস্বাস্থ্য থেকে পালিয়ে যাওয়া অসংখ্য ডাক্তারের অন্যতম ছিল নজরুল। সে পালিয়ে গিয়েছিল কুমুদিনী হাসপাতালে।
আমি ন্যস্ত হলাম প্রশিক্ষণ সমণ্বয়কারী ডা. তারিকুল ইসলাম ভাইয়ের বিশ্বস্ত হাতে। হাসপাতাল চক্কর দিয়ে দেখালেন, আলাপ করিয়ে দিলেন গণস্বাস্থ্যের দুই মহীরুহ ডা. কাশেম ভাই আর ডা. মোরশেদ ভাইয়ের সাথে; দুজনেই চৌধুরী। দুপুরে ঘর্মাক্ত কলেবরে রিসেপসন এরিয়াতে পৌঁছলেন ডা. মোহাম্মদ ইকবাল ভাই, বলছিলেন কোনো একটা ময়না তদন্তের কাজে দূরের গ্রাম থেকে ফিরলেন।
প্রথম দুই সপ্তাহ প্রধান চাকুরি হল দিনের বেলা আউটডোর, বিকেলে মোটর সাইকেল চালানো শেখা আর সন্ধ্যায় লাইব্রেরি, সেমিনার ইত্যাদিতে হাজির থাকা। সপ্তাহে এক বা দুদিন মৌখিক ময়না তদন্তে (Verbal Autopsy) যাওয়া। আউটডোর আর সাব-সেন্টারে রোগী দেখা বা ইনডোর ডিউটির অনুমতি মিলবে সংগত ঔষধের ব্যবহার শিখে বাংলায় ব্যবস্থাপত্র লিখতে পারলে। আমার শ্লাঘা ছিল কলেজ লাইফে তো মোটর সাইকেল শিখেছিলাম, কিন্তু আলাউদ্দীন আর নজরুলের সাথে নিরিবিলি হাউজিং এর মাঠে চালাতে গিয়ে দেখি অত কনফিডেন্স পাই না। আমার মেডিকেল কলেজের বান্ধবী ডা. সুলতানা আলগিন আর ডা. নাসরিন হককে পেলাম; ওদের ট্রেনিং শেষ কিন্তু মোটর সাইকেলটা সরগর না হওয়াতে ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে পোস্টিং বিলম্বিত হচ্ছে। আমিও নগর হাসপাতালের জন্যই নিযুক্ত হয়েছি।
গণ মেসের (ডাইনিং) খাবার ছিল অধিকাংশ বেলাতেই শাক সবজি – বিশেষ করে নানা ধরনের কচু; আমিষ হত সপ্তাহে এক বেলা – মাছ, মাংস কিংবা ডিম। সবাই যার যার বেতন অনুপাতে মেসে কন্ট্রিবিউট করতে হবে, তবে একটাই মেনু। কয়েকদিন পর, ডাইনিং এর বিখ্যাত লাবড়া দিয়ে ভাত খেয়ে হোস্টেলে ফিরেছি, পথে দেখা হলো অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারী কর্মকর্তা, যিনি সম্প্রতি এখানে যোগ দিয়েছেন জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে। হোস্টেলে ফিরতেই তিনি বললেন- ‘জানেন নাকি? বনে বাঘ এসেছে!’ অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘বড় ভাই’ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাভার ক্যাম্পাসে এসেছেন! দু’একদিন থাকবেন হয়ত। তাঁকে নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক গল্পকাহিনি আর কিংবদন্তি শোনা হয়ে গেছে। গল্পগুলো থেকে আমার জন্য শিক্ষণীয় ছিল এই ‘বড় ভাই’ এর কাছ থেকে দূরে এবং অচেনা থেকেই সময়টা পার করে দিতে পারাটা আমার জন্য নিরাপদ। ডাক্তাররা তাঁর মন মতো হতে পারেন না, তাঁর মর্জিমতো কাজ করতে পারেন না। আসলে তিনি যা চান তা হয়ত নতুন চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন না — চিকিৎসকরা কোনোকালেই পাবলিক হেলথের ওরিয়েন্টেশন নিয়ে বেড়ে উঠেনি। আর আমি? আমি তো এসেছি চাকুরি করতে, বিপ্লব করতে নয়। যদিও ‘মাসিক গণস্বাস্থ্য’ পত্রিকা আর ‘গণ প্রকাশণী’র প্রকাশিত বই ‘যেখানে ডাক্তার নেই’ বা ‘ঝগড়াপুর’ পড়েছি ইন্টারমিডিয়েট লাইফেই। প্রথম দিনেই আবারও গণ প্রকাশণীর কিছু বইপত্র কিনলাম – সঙ্গত ঔষধের ব্যবহার, ম্যালেরিয়া, বুকের দুধ খাওয়ানো ইত্যাদি নানা বিষয়ে লেখা ছিল সেই সব বই- অধিকাংশই অনূদিত।
পরদিন বিকেলে মোটর সাইকেল গ্যারেজে গেছি। আতাউর নামের এক স্বাস্থ্যকর্মী আমার জন্য কালো রংয়ের বাজাজটা বের করে দিল। এবার আমি অশ্বারূঢ় হব নাকি ঠেলতে ঠেলতে মাঠে নিয়ে যাব ভাবছি। দূর থেকে বড় ভাই জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঘটনা লক্ষ্য করে আমাকে ডাকলেন, পরিচয় নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘মোটর সাইকেল চালাতে পার কিনা?’ বললাম, ‘মোটামুটি।’ সাথে সাথে চার দিকে চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে বললেন, ‘একজন ডাক্তার ছেলে হয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে এত হিমশিম খেলে চলবে?’ সাথে সাথে গ্রামীণ স্বাস্থ্য সমণ্বয়কারী ডা. মনজুর কাদির আহমদ ভাইকে ডেকে নির্দেশ দিলেন যতদিন মোটর সাইকেল রপ্ত না হবে, ততদিন আমার আর আমার বান্ধবীদের সব ডিউটি বন্ধ; সারাদিন মোটর সাইকেল চালাতে হবে!
চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে কথা বলতে দেখতাম তাঁর একজন উত্তরসূরিকেও, সে কথা আরেক দিন হবে।
নিরিবিলির মাঠ, নবীনগর, পল্লী বিদ্যুৎ এই সব সন্নিহিত এলাকায় মোটর সাইকেল চালাতাম, তেল মবিল কিনে নিতাম প্রয়োজন মতো – এইভাবে কয়েকদিন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরতে ঘুরতে নিজেকে বেকার বা ভবঘুরের মতো লাগছিল। কিন্তু কয়েকদিন পরেই সেই ‘শাস্তি’ শিথিল করে দেয়া হল। যথারীতি সিকরুম ও উপকেন্দ্রগুলোতে ডিউটি করতে লাগলাম।
জবরদস্তি হোন্ডা শিখতে গিয়ে কাঁঠাল ট্যাকের অদূরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডা. আলগিন তার হাতের একটা ছোট্ট হাড্ডি (স্টাইলয়েড প্রসেস) ভাঙ্গল!
লেখক – ডা. মোশতাক আহমদ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন।
ছবি – গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আর্কাইভ
আরও খবর পেতে দেখুনঃ ইতিহাসের ডায়েরী – খোলা জানালা
Gonoshasthaya Hospital, Gonoshasthaya Hospital, Gonoshasthaya Hospital, Gonoshasthaya Hospital