কার্যকর পদক্ষেপ নিলে ইউনাইটেড নিহত পাঁচ জনের জীবন বাঁচাতে পারতো
হাইকোর্টে প্রতিবেদন
অগ্নি-দুর্ঘটনা চলাকালে আগুন নেভাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে রাজধানীর গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিহত পাঁচ জনের জীবন বাঁচানো সম্ভব হতো বলে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
সরকারের আরও দুটি সংস্থা তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে, হাসপাতালটির অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামাদির বেশিরভাগই ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ ও অকেজো।
এ সংক্রান্ত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা রবিবার (১৪ জুন) বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে মোট তিনটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। আগামী ২২ জুন এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি ও আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছেন আদালত।
ফায়ার সার্ভিস ছাড়াও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ও রাজউকের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে তুলে ধরেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার। অন্যদিকে হাসপাতালের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মুস্তাফিজুর রহমান খান। আর রিটকারীর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার মুনতাসির উদ্দিন আহমেদ ও অ্যাডভোকেট নিয়াজ মাহমুদ।
উল্লেখ্য, গত ২৭ মে রাতে রাজধানীর গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ইউনিটে আগুনে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃতদের মধ্যে চার জন পুরুষ এবং একজন নারী। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট তিন সরকারি সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
পরে ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যের কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন সেন্টারে কর্মরত ব্যক্তিরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থেকে ধোঁয়া দেখামাত্র প্রাথমিকভাবে আগুন নেভানোর চেষ্টা, ইমার্জেন্সি এলার্ম বাজানো, রোগী অপসারণ ও হাসপাতালের অগ্নিনির্বাপণ দলকে উপস্থিত হতে জরুরি অনুরোধ করলে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ও রোগীদের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হতো। এছাড়া, ওই এসি থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ নির্গত হতে দেখেও কর্মরত উপস্থিত ব্যক্তিদের (ডাক্তার, তিন জন নার্স ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী) আগুন নেভানোর ব্যাপারে ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা অন্যান্য আগুন নেভানোর সরঞ্জামাদি ব্যবহারে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। ফলে অগ্নিকাণ্ডের সময় আগুন নেভাতে উপস্থিত ব্যক্তিদের গাফিলতির কারণে ঘটনাটি ঘটে বলে তদন্ত কমিটি মনে করে।
ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের সময় অগ্নি-নিরাপত্তা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক ফায়ার সেফটি অফিসার ও অগ্নি-নির্বাপণ দলের সদস্যদের উপস্থিত থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। আইসোলেশন সেন্টারে সব ধরনের অগ্নি-প্রতিরোধ ব্যবস্থা স্থাপন করা দরকার ছিল। ইউনাইটেড হাসপাতালটি স্পর্শকাতর এলাকায় অবস্থিত। সেখানে দেশি-বিদেশি গণ্যমান্য ব্যক্তিরা চিকিৎসা নিতে আসেন। এ ধরনের স্পর্শকাতর এলাকায় সেবা প্রদানে পর্যাপ্ত অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া এ ধরনের আইসোলেশন সেন্টার নির্মাণ ঠিক হয়নি। অস্থায়ী সরঞ্জামাদি দিয়ে তৈরি না করে স্থায়ী অথবা অগ্নি-প্রতিরোধযোগ্য নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে এ ধরনের আইসোলেশন সেন্টার তৈরি করা উচিত ছিল।
অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে সুপারিশ:
কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, ইউনাইটেড হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে সার্বক্ষণিক ফায়ার সেফটি অফিসার, কার্যকর অগ্নিনির্বাপণকারী দলের সদস্যদের সরঞ্জামসহ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। নিয়মিত অগ্নি-নির্বাপণ প্রশিক্ষণ ও ফায়ার অ্যান্ড ইভাকুয়েশন ড্রিল করা এবং যথাযথভাবে রেজিস্ট্রার রক্ষণাবেক্ষণ করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এছাড়া, হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা রোগীর সঙ্গে অবস্থান করেন, তাদের মধ্য হতে ২৫ ভাগ জনবলকে অগ্নি-নির্বাপণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এছাড়া বিএনএসবির আলোকে ভবনের বেজমেন্টে কোনও স্থাপনা, যেমন— অফিস, স্টোর, কিচেন, ডাইনিং ইত্যাদি স্থাপন করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং বেজমেন্ট শুধু গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ব্যবহার করা যাবে।
এদিকে একই ঘটনায় আদালতে রাজউকের দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমতি নিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইসোলেশন সেন্টার নির্মাণ করে। কিন্তু রাজউকের কোনও ধরনের অনুমোদন তারা নেয়নি।’
আর ডিএমপির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অগ্নিকাণ্ড সংঘটন ও তা প্রতিরোধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ছিল।’
রিটকারীর আইনজীবী নিয়াজ মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, ‘আজকে রাষ্ট্রপক্ষ তিনটি সংস্থার তদন্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করেছে। আমরা রিপোর্টগুলো পাইনি। রিপোর্টগুলো দেখে আমাদের জবাব দাখিল করবো। তাই আদালত শুনানি ও আদেশের জন্য আগামী ২২ জুন দিন ধার্য করেছেন।’
সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন