ইতিহাসের ডায়েরী

শোন বলি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গল্প – তৃতীয় পর্ব: গতিপথ

তৃতীয় পর্ব: গতিপথ
(ডা. মোরশেদ চৌধুরীকে উৎসর্গীকৃত)

আমি ডা. তারিক ভাইয়ের মতো ‘বাই চয়েস’ গণস্বাস্থ্যে যাইনি, আমি গিয়েছিলাম ‘বাই চান্স’। কিন্তু এই সুযোগ সন্ধানী যাত্রা আমার বাকি জীবনের গতিপথ সৃষ্টি করে দিয়েছে।

হঠাৎ একদিন শেরপুরের ভাতশালা কেন্দ্র থেকে অপু ভাই (ডা. মোঃ সাঈদ-উজ-জামান) চলে এলেন সাভার কেন্দ্রে। তার পিছু পিছু এল নৃবিজ্ঞানের ছাত্র কুমকুম; আমাদের পুষ্টিবিদ সুফিয়াসহ আরও তিনজন নারী যোগ দিলেন এই দলে। অপু ভাই আর কুমকুম আমাদের হোস্টেলেই উঠলেন।

ডা. অপু ভাই একটা গবেষণা দলের নেতৃত্ব দিবেন- অসুখ বিসুখ নিয়ে গ্রামের লোকের ধারণা কি, অসুখ হলে তারা কোথায় যায় এবং কেন যায় ইত্যাদি ছিল গবেষণার বিষয়। অপু ভাই আর কুমকুমের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে অনেক কিছু জানা হত, শেখা হত৷ সপ্তাহে একবার ওদের কাজের অগ্রগতি জানতে আইসিডিডিআর’বির একটা দল আসত। যখন সবাই মিলে ‘সয়াবিন চা গরম’ ক্যান্টিনে বসতেন, পাবলিক হেলথের অনেক দিকপালদের নাম শুনতাম।

‘সয়াবিন চা গরম’ ক্যান্টিনের সাইনবোর্ড দেখে কৌতূহল হল। জানতে পারলাম, ১৯৭৩ সালে জাফর ভাই অপুষ্টি দূর করার জন্য সয়াবিন চাষের প্রচলন করেন ও কৃষকদের মাঝে বীজ বিতরণ করে তা প্রসারের চেষ্টা করেন। ‘৭৫ সালে এই ক্যান্টিন চালু হয় ও সয়াদুধের চা শুরু শুরু হয়। তাই এই ক্যান্টিনের নাম দেন ‘সয়াবিন চা গরম’ ক্যান্টিন।

‘সয়াবিন চা গরম’ গণস্বাস্থ্যের প্রথম বাণিজ্যিক কার্যক্রম। ক্যান্টিনে ঝর্না সরকার নামে একজন তরুণী ম্যানেজার ও নারী কর্মীদের নিয়োগ দেয়া হয় যা তখনকার প্রেক্ষাপটে গ্রামবাসী কিংবা পাশের ঢাকা–আরিচা মহাসড়কের বাস-ট্রাকের চালকদের পক্ষে সহজভাবে নেয়া কঠিন ছিল। ধীরে মানুষও যেমন অভ্যস্ত হতে থাকল, সয়াদুধও জনপ্রিয়তা পেল আর জিকেও অনুধাবন করল নারীদেরকে দিয়ে ব্যবসা-সফল উদ্যোগ নেয়া সম্ভব। এই ঝর্না সরকার পরবর্তীতে ডা. মোরশেদ চৌধুরীর সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। তার ক্যারিয়ার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী উন্নয়নের (Women Empowerment) অন্যতম একটা উদাহরণ।

‘সয়াবিন চা গরম’ ক্যান্টিনে বাংলাদেশের উন্নয়ন জগতের অনেক রূপকার চা খেয়েছেন; যেমন, আবেদ ভাই (স্যার ফজলে হাসান আবেদ), অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনুস কিংবা ড. ওয়াজেদ মিয়া। শিল্পী এস এম সুলতানও এই ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিতে দিতে নতুন বাংলাদেশের চিত্রকলা নিয়ে ভেবেছেন। এখন ছফুরা নামের এক মেয়ে চা সিংগারা আর ডালপুরি পরিবেশন করে, কিন্তু সেই সয়াদুধ আর নেই। মাইক্রোবায়োলজিস্ট এক অধ্যাপক ‘ছফুরা, ছফুরা’ বলে ডাকতেন বলে ছফুরার নাম মনে আছে, কিন্তু স্যারের নাম মনে নাই। একই জায়গায় গণ বিপণন নামের মুদি দোকানটি চালান মঞ্জুদি। বছর তিনেক আগেও একবার মানিকগঞ্জ থেকে ফেরার পথে জিকের ক্যান্টিনে থেমেছিলাম। মঞ্জুদি তখনও ছিলেন, কিন্তু আমাকে চিনতে পারেননি।

যাক যা বলছিলাম। সপ্তাহে একবার করে লেবার রুমে সংগৃহীত মায়েদের গর্ভফুলের (Placenta) রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে আসত ঢাকা থেকে আরেকটা দল। এই দুটো ঘটনা ছিল স্বাস্থ্য গবেষণার দুটো নমুনা কাছ থেকে দেখা। জিকের সব গবেষণার সমন্বয়ক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসক ডা. মোরশেদ চৌধুরী, যিনি বিচিত্রার শাহাদাৎ চৌধুরীর ভাই ও মেজর খালেদ মোশাররফের সহযোদ্ধা। মোরশেদ ভাই মেডিকেলের চতুর্থ বর্ষে পড়ার সময় ‘বাংলাদেশ হাসপাতালে’ যোগ দিতে একাত্তরের রণাঙ্গনে যান।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে এতদিন শিখেছি প্রেসক্রিপশনের ডান দিক আর বাম দিকের সমীকরন মিলানো, সংগত ওষুধের ব্যবহার, কঠিন পরিশ্রমে অভ্যস্ত হওয়া – এইগুলো। এবার অন্য দিকে অন্য কিছু খুঁজছে আমার দৃষ্টি। গ্রামে পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যু হলে কিংবা মাতৃ মৃত্যু হলে একজন স্বাস্থ্যকর্মীর সাথে সরেজমিনে গিয়ে মৌখিক ময়না তদন্তের (Verbal Autopsy) সময় সদ্য স্বজনহারা মা-বাবা কিংবা স্বামী বা শাশুড়ীর সাথে কথা বলা ছিল খুবই বেদনার, চ্যালেঞ্জের।

একদিন চোখে পড়ল কিংবা বলব দৃষ্টি আকর্ষণ করল হাসপাতালের নিচ তলায় একটা কালো রঙের পোস্টারে কালো এক কিশোরীর ছবি। কাছে গিয়ে পড়া গেল আমস্টারডাম ইউনিভার্সিটির চিকিৎসা নৃবিজ্ঞান বিষয়ে ছাত্র ভর্তির আহ্বান। অপু ভাইদের সাথে মিশে, আমস্টারডাম ফেরত তারিক ভাইয়ের কিছু অভিজ্ঞতা শুনে আর সর্বোপরি মোরশেদ ভাইয়ের ‘আই হেইট টু বি এ ক্লিনিশিয়ান’ শুনে শুনে আমি দু’মাসেই অনেকটা পরিবর্তিত মানুষ। অনেকটা মগজ ধোলাই হয়ে গেছে। মনস্থির করে ফেললাম, মেডিসিন বা সার্জারি নয়, পাবলিক হেলথেই কাজ করব। ওই কালো পোস্টারটা আমার স্বপ্নকে আরো জাগিয়ে তুলেছিল।

‘আই হেইট টু বি এ ক্লিনিশিয়ান’ গল্পটা এরকম। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এক ছোট শিশুর ডায়রিয়া। বমি করে সব ফেলে দিচ্ছে। পেট ফেঁপে ঢোল। পেটে কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শিরাপথে কলেরা স্যালাইন চলছে। কিন্তু উন্নতি হচ্ছে না। শিশু বিশেষজ্ঞ এক্স-রে দেখে ওপ্যাসিটি, ফ্লুইড লেভেল ইত্যাদি আছে বলে-টলে সার্জনকে রেফার করলেন (কোনো শিশু বিশেষজ্ঞকে ব্যক্তিগতভাবে উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন; এটি সিস্টেমের বহিঃপ্রকাশ। জিকের শিশু বিশেষজ্ঞগণ আমাদের ক্যাম্পাসের বাচ্চাদের গুরুতর অসুখেও সফলভাবেই নিদান দিয়ে থাকেন)। তারপর, সার্জন এসে এই একিউট ম্যাজিক বক্স অর্থাৎ পেটটা কাটবেন কি কাটবেন না ভাবছেন আর কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে দিলেন। স্বাস্থ্যকর্মীরা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের আগমন-প্রস্থান আর বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ আর ধমকা-ধমকিতে অস্থির। মোরশেদ ভাইয়ের কানেও হৈ চৈ এর শব্দ গেল। সিকরুম (ইনডোর) কিছুটা পদভারমুক্ত হলে উনি এসে গোঁফের আড়াল থেকে রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, ‘এই বনানী কুবি, কই গেলি, এক চামুচ পটাশিয়াম সিরাপ এনে দে তো!’ (সাধারণত জাফর ভাই আর মোরশেদ ভাই অনেক কর্মীকেই তুই করে বলতেন। কাজ পছন্দ না হলে কাঁঠাল পাতা ছিঁড়ে এনেও খাওয়াতে চাইতেন)। সিরাপ খাওয়ার দুই ঘন্টার মধ্যে বাচ্চা উঠে বসল, পেটও বসে গেল তো বটেই; পরদিন দুপুরে দেখি বাচ্চাটি এক থালা ভাত নিয়ে বসে খুশিমনে খাচ্ছে। এই ঘটনার পর মোরশেদ ভাই বললেন, ‘আমি কেন সিকরুমে আসি না বুঝতে পেরেছ? আই হেইট টু বি এ ক্লিনিশিয়ান!’

যে আত্মগৌরবের সাথে তিনি এই কথা কয়টা উচ্চারণ করেছিলেন, সেই আত্মবিশ্বাস দেখেই পরবর্তীতে আমিও হয়ত মুক্তিযোদ্ধা মোরশেদ ভাইয়ের প্রতিধ্বনি করেছিলাম। একদিন গল্প করেছিলেন হ্যারিকেনের আলোয় কিভাবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের শরীর থেকে একটা একটা বুলেট বা পিলেট বের করতেন। আরেক দিন বলেছিলেন কোনো এক মুক্তিযোদ্ধার ঢাকার বাড়ির উঠোনে গর্ত করে অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখার কথা।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে তিনি ঠিক ১১ বছর ১১ মাস ১১ দিন কাজ করার পর ‘৯৭ এর শেষে ব্র‍্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসুচিতে চলে আসেন ডা. মোরশেদ চৌধুরী (হিসেবটা তার ছেলে খালেদের মুখে শোনা)। আমিও তাঁর হাত ধরেই ব্র‍্যাকে যাই, আমি অবশ্য ব্র‍্যাকে এক যুগ পার করেছিলাম। উল্লেখ্য, খালেদের নামটি মেজর খালেদ মোশাররফের নাম থেকেই নেয়া।

মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের শিষ্য মোরশেদ ভাই আবার ফিরে গিয়েছিলেন গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান হিসেবে, ছিলেন আমৃত্যু, ওখানেই সমাহিত।

*ডা. মোরশেদ চৌধুরী, একজন মুক্তিযোদ্ধা, জনস্বাস্থ্য যোদ্ধা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ও গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান।

লেখক – ডা. মোশতাক আহমদ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন।

(ধারাবাহিক…)

 

আরও খবর পেতে দেখুনঃ ইতিহাসের ডায়েরী খোলা জানালা

Historical News, Historical News, Historical News

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seven + three =

Back to top button