শোন বলি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গল্প; পঞ্চম পর্ব: অনুষ্ঠান ও সংগ্রামের নানা গল্প
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পঁচিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান হয়েছিল জমকালো, দেশি বিদেশি অনেক অতিথি অভ্যাগত এসেছিলেন। এই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯৬ এর শেষের দিকে। আমি ততদিনে গাজীপুরের শ্রীপুর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হয়ে চলে গেছি। আমি শ্রীপুর প্রকল্পের ম্যানেজার আবদুর রহমান ভাইয়ের কাছ থেকে রজত জয়ন্তীর খোঁজ-খবর কিছু কিছু পেতাম। অনুষ্ঠানের আগে আগে উনি আমার মোটর সাইকেলটা নিয়ে সাভারে চলে গেলেন!
এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আমি সাভারে গিয়ে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের কিছু পর্ব ধরতে পেরেছিলাম। ‘সয়াবিন চা গরম’ ক্যান্টিন সেদিন অনেক তারকায় ঝলমল করছিল। মূল অনুষ্ঠান চত্বর ছিল মার্জিত এবং আকর্ষণীয় সাজে সাজানো। সেই রজত জয়ন্তীর একটাই স্মারক আমার কাছে রয়ে গেছে, তা হল, চাকুরি ছাড়ার পর রজত জয়ন্তীর লেটারহেড প্যাডে তারিক ভাই আমাকে একটি প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন, সেইটি। এই ঘটনা ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরের।
শ্রীঘর- থুড়ি, শ্রীপুরবাসের চারটি মাস নিয়ে পরে বলব। আজ সাভার জিকে’র কিছু অনুষ্ঠানের কথা বলি। তার আগে মোটর সাইকেলের অগ্রগতি জানিয়ে রাখি। আমি গ্রামের পথে মোটর সাইকেল নিয়ে সপ্তাহে একদিন শ্রীপুর এমসি বাড়ি থেকে মাওনা শিশু পল্লীর ক্লাস এইট আর নাইনের ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য শিক্ষার ক্লাস নিতে যেতাম।
‘শহীদ নিজাম দিবস’ জিকে কর্মীদের একটি সার্বজনীন অনুষ্ঠান। শিমুলিয়ার স্বাস্থ্যকর্মী নিজামউদ্দিনকে প্রাণ দিতে হয়েছিল আধিপত্যকামীদের হাতে। শিমুলিয়াসহ আরো কয়েকটি উপকেন্দ্র চালু করে কম খরচে গ্রামের মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার প্রয়াসে পল্লী চিকিৎসকগণ তাদের ঔষধ ব্যবসায়ের জন্য হুমকি হিসেবে দেখল। ফলে ১৮ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে শিমুলিয়া কেন্দ্রে নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছিল নিজামকে। নিজাম হত্যার সেই দিনটিতে প্রত্যেক বছর ২রা অগ্রহায়ণ কিছু অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শহীদ নিজামকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হত। কর্মীরা সম্মান প্রদর্শন করতে পায়ে হেঁটে জিকে থেকে ৫ মাইল দূরবর্তী শিমুলিয়া সাব-সেন্টার পর্যন্ত মিছিলসহ আসত। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সাভার ক্যাম্পাসের ভিতরেই শহীদ নিজামের কবর।
আমার অবস্থানকালীন পুরনো কর্মীদের কাছে যতটুকু শুনেছি, ধনাঢ্য হিতৈষির কাছ থেকে সাভার জিকের জমিটা পেয়ে সেখানে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়। রাতে কর্মীরা পালাক্রমে সীমানা পাহারা দিত যাতে করে রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে কেউ সীমানা প্রাচীর সংকুচিত করে দিতে না পারে; অন্যদিকে গণস্বাস্থ্যের কর্মীরা ছিল অতন্দ্র প্রহরী।
সাধারণ কর্মীরা খুব সাধারণ ঘর থেকে এসে ‘বড় ভাই’ নামের হীরকখণ্ডে আলোকিত হচ্ছিল আর ক্ষমতায়িত হচ্ছিল; তাঁদের কাছে হয়ত সেটাই ছিল আদর্শের ধারণা, ‘বড় ভাই’ এর আদেশ থাকুক কিংবা নাই থাকুক!
আরেকটি প্রাণের অনুষ্ঠান ছিল ‘বার্ষিক ধান কাটা’। সকল কর্মী সেদিন প্রকল্পের ভিতরে ধান কাটার উৎসবে নেমে পড়ত। এমন একটা উৎসবে নিজে শামিল না হলেও যেদিন পুকুরগুলো পানি সেঁচে মাছ ধরা হত, তেমন একটা দিনের স্মৃতি মনে আছে আমার। আমি ততদিনে জিকের ‘১৮ ফ্ল্যাটে’র ছয়শত বর্গফুটের নতুন বাসায় সপরিবারে উঠে গেছি। সেই বিল্ডিঙয়ে মোট ১৮ টি ফ্ল্যাট ছিল বলে ১৮ ফ্ল্যাট নাম হয়েছিল। সেদিন কিছু আইর মাছ আর কাদার গভীরে লুকিয়ে থাকা শোল মাছ সংগ্রহ করেছিলাম। যার যার ইচ্ছামতো অল্প দামে মাছ কিনে নেয়ার ব্যবস্থা ছিল।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অনেকগুলো সহযোগী প্রতিষ্ঠান বা সিস্টার কনসার্ন বলা ভাল, তা ছিল। যেমন: গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস, গণস্বাস্থ্য এন্টিবায়োটিক (১৯৮৪ সালে শুরু। পুরো প্রকল্পে ছিল ঔষধ বা বর্জ্যের ভারী গন্ধ; এন্টিবায়োটিকের আঁচ থাকলেও তা হয়ত আদৌ স্বাস্থ্যকর ছিল না), গণস্বাস্থ্য ভ্যাকসিন গবেষণাগার, গণ পাঠশালা, গণ মুদ্রণ, গণ প্রকাশণী, গণ পাদুকা (আমার স্ত্রীর একমাত্র বিলাসিতার জায়গা), নারী কেন্দ্র ইত্যাদি। নারী কেন্দ্র হচ্ছে গণস্বাস্থ্যের নারী উন্নয়ন কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে গ্রামীণ মহিলারা অ-প্রচলিত ব্যবসা; যেমন, বৈদ্যুতিক ওয়ারিং, ছাপার কাজ, বই বাঁধাই, ছুতারগিরি, ধাতব শিল্পকর্ম, ওয়েল্ডিং, গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ, বয়লার ও পাওয়ার টিলার চালানোর প্রশিক্ষণ এবং কাপড় রঙ করা ইত্যাদি কাজে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ লাভ করে।
জামিলা, সম্ভবত উপমহাদেশের প্রথম নারী বয়লার অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করে ১৯৮৪ সালে।
গণস্বাস্থ্যের ছিল নিজস্ব ব্যাংকও; কর্মীদের বেতন, বিল ইত্যাদি সেই ব্যাংকের মাধ্যমে পাওয়া যেত। অনেক সময় সারা মাসের ট্রাভেল বিল (বাস, ভ্যান, রিকশা, শ্যালো নৌকা) বাবদ ১২০/১৩০ টাকার চেকও পেয়েছি! মোটর সাইকেলে শুধু মীরেরচানগাও যেতাম; পানিশাইলে যেতে হলে জরুনগামী মোটরসাইকেল আরোহীর লিফট নেয়া যেত। এছাড়া নারীদের ড্রাইভিং স্কুল, কাঠের কাজের কারখানা এসব ছিল। প্রকল্পের অধিকাংশ ড্রাইভারই নারী।
এই ফাঁকে মালেকার কথা বলে ফেলি। মালেকা নামে জিকের একজন নারী গাড়িচালক ছিলেন যিনি নবীনগর এলাকায় টেম্পো চালাতেন। শুরুতে তিনি ‘সয়াবিন চা গরম’ ক্যান্টিনে কাজ নেন, নিজের আগ্রহে পড়াশুনা শিখে আত্মবিশ্বাসী হন। মালেকা পরবর্তীতে নারী কেন্দ্রে গিয়ে ড্রাইভিং শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু এতে তার স্বামী ও মেয়ের জামাই বিরূপ হন এবং মালেকা আর তার মেয়ে দুজনেই তালাকের হুমকি পান। মালেকা তার গ্রামের মাতবরদেরকে বুঝান যে তার ও তার মেয়ের থাকা খাওয়ার নিশ্চয়তা থাকলে তিনি তো আর ড্রাইভার হতে চাইতেন না। দারিদ্র জয়ের এই অঙ্গীকার দেখে গ্রামের মাতবররা তার স্বামী ও মেয়ের জামাইকে বুঝান। নারী কেন্দ্র মালেকাকে একটি টেম্পো দেয় এবং মালেকা সেটা নয়ারহাট থেকে গাজীরচট রুটে চালাতে শুরু করে। এখানে শুরু হয় নতুন প্রতিবন্ধকতা। পুরুষ টেম্পো ড্রাইভাররা তার পথ আগলে রাখে। মালেকা শেষ পর্যন্ত পরিবহন সমিতির সদস্য হয়ে এই প্রতিকূলতা জয় করেছিল।
মালেকাই বাংলাদেশে গণ-পরিবহনের প্রথম নারী গাড়িচালক (The first professional licensed female driver in public transport in Bangladesh-1989)। অন্যদিকে সালেহা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার নারী গাড়িচালক (The first professional female driver in Bangladesh-1985)। সালেহা ১৯৮৫ সালে শুরু হওয়া জিকে ড্রাইভিং স্কুল থেকে প্রশিক্ষিত। তিনি পরবর্তীতে ইউনিসেফের (UNICEF) গাড়িচালক হিসেবে চাকুরি করেছিলেন।
‘৯৭-‘৯৮ সালে যাকে সাভারে ড্রাইভার হিসেবে পেয়েছিলাম, সেই রেখা দিদিকেই ২০১২ তে পেলাম জিকে কক্সবাজার ড্রাইভিং স্কুলের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে; সেবারে ‘কেয়ার বাংলাদেশ’ কক্সবাজারের পক্ষ থেকে নারী দিবসে নারী ড্রাইভারদেরকে নিয়ে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলাম। রেখাদির সাথে এসেছিলেন আরো চারজন প্রশিক্ষণার্থী নারী গাড়িচালক। স্থানীয় ‘দৈনিক সমুদ্রকন্ঠে’ সেই অনুষ্ঠানের ভিত্তিতে একটি ক্রোড়পত্রও প্রকাশিত হয়েছিল। রেখাদি কালক্রমে বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংক (The World Bank) প্রধানের ড্রাইভার হয়েছিলেন। বিদেশী সংস্থায় চাকুরি করতে যাবার আগে এরা গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে অল্প সময়ে ইংরেজি ভাষাও রপ্ত করে নিয়েছিলেন!
জিকের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে (নির্মাণ) ইঞ্জিনিয়ার অনিল ভৌমিক বসতেন। অনিল দা পানিতে ডাইভ দিতে গিয়ে মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে পক্ষাঘাতের কারণে হুইল চেয়ারে চলাচল করতেন, প্রায়ই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসতেন।
যাহোক, অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বলছিলাম। নারী কেন্দ্রের নেতৃত্বে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালন করা হত। এর অংশ হিসেবে নারী কর্মীরা ঢাকার জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিত। একবার নারী দিবসের অনুষ্ঠানে আমাকে মেডিকেল টিমের সদস্য হিসেবে ঢাকায় আসতে হয়েছিল। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠানটি ছিল। সারাদিন বিপ্লব করে বিকেলে ফিরে গিয়েছিলাম। গণস্বাস্থ্য আগাগোড়াই নারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিল, নারী কর্মীরা ছিল বিশেষভাবে সচেতন।
১৯৭৩ সালে জিকে নারী প্যারামেডিকদের প্রশিক্ষণ শুরু করে। ১৯৭৪ সালে নারী স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন ‘বৈপ্লবিকভাবে’ সাইকেল চালিয়ে গ্রামের নারী এবং শিশুদের খোঁজ নিতে যেত, তখন মহাসড়কের বাস-ট্রাকচালকেরা তাদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনায় ফেলতে চাইত। স্বাস্থ্যকর্মী মিনু তার বাইসাইকেল নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন, গাজিপুর। বাড়ি থেকে সাইকেলে ফেরার পথে ঢাকা-টাংগাইল মহাসড়কে সখিপুর এর কাছাকাছি এপ্রিল ১৭, ১৯৭৯ (মঙ্গলবার) মিনুকে একজন ট্রাকচালক পিছন থেকে মেরে দিয়েছিল! ২৩ দিন হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে মে ৯, বুধবারে মিনু মারা যান (বৈশাখ ২৫, ১৩৮৬)। আরো কত বাধা-বিপত্তি জয় করতে হয়েছে প্রতিদিন!
১৯৭৭ সালের মে দিবসে গণমাধ্যম ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মহিলা ডাক্তার লায়লা পারভীন বানুসহ (পরবর্তীতে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) ২৩ জন নারী নবীনগর থেকে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে অতিক্রম করেন। সেই র্যালিতে অংশগ্রহণকারীদের টি-শার্টে লেখা ছিল ‘আমরা স্বাস্থ্য শ্রমিক’। সেটি ছিল সারা বিশ্বের শ্রমিকদের সাথে একাত্মতা ঘোষণার একটি প্রয়াস।
নারীদের জন্য নানা ধরণের জীবনমুখী প্রশিক্ষণের কথা তো আগেই বলেছি। দরিদ্র নারীরা সেলাই থেকে শুরু করে রাজমিস্ত্রির কাজও শিখতে পারত। এমন একজন নারী ছিল ধামরাইয়ের মরিয়ম, যার কাছে আমার স্ত্রী ধামরাইয়ের রথের মেলার সন্ধান পেয়েছিল।
লেখক – ডা. মোশতাক আহমদ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কবি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন।
(চলবে..)
আরও খবর পেতে চোখ রাখুনঃ ইতিহাসের ডায়েরী – কর্পোরেট নিউজ
Historical Bd News, Historical Bd News, Historical Bd News