ইতিহাসের ডায়েরী

শোন বলি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গল্প; ষষ্ঠ পর্ব: পাবলিক হেলথের ছবক

পাবলিক হেলথে আমার প্রথম পাঠ বা লেসন ‘হাওয়া’ নামের এক স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে পাওয়া।

জিকের প্রথম সপ্তাহের কথা। অর্থাৎ আষাঢ় মাস, মতান্তরে ‘৯৬ সালের জুলাই মাস। ‘গ্রামে চল, গ্রাম গড়’ শ্লোগান নিয়ে যে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মীরা কমিউনিটিতে একই ধরনের জীবনযাত্রা নিয়ে একত্রে বসবাস করে নানা কর্মকাণ্ডে যাকে বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই অসংখ্য গ্রামের একটি গ্রাম দেখাতে নিয়ে গেল হাওয়া নামের এক চটপটে স্বাস্থ্যকর্মী। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, ‘উত্তরা থানায়’। সে হয়ত ঢাকা শহরের কাছাকাছি জায়গা থেকে এসেছিল কিন্তু অধিকাংশ স্বাস্থ্যকর্মী এসেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে।

জাফর ভাইদের নজরে এটাও থাকত, যেন একটি দরিদ্র পরিবার থেকে অন্তত একজন মেয়ে প্যারামেডিক হিসেবে প্রশিক্ষিত হতে পারে, এতে ঐ পরিবার ও তার কমিউনিটি লাভবান হয়। ভর্তিচ্ছু স্বাস্থ্যকর্মীদের আবেদনগুচ্ছ থেকে যে মেয়েটি তার দরখাস্ত আর জীবনবৃত্তান্ত স্ট্যাপলার পিন দিয়ে না গেঁথে সুই-সুতা দিয়ে সেলাই করে পাঠিয়েছে, তার জন্যেই ছিল অগ্রাধিকার।

এসএসসি পাশ স্বাস্থ্যকর্মীরা কেউ কলেজে পড়তে চাইলেও শিক্ষাছুটির সুযোগ ছিল, পাশেই মির্জা গোলাম হাফিজ কলেজ বা সাভার কলেজে কাউকে কাউকে পড়তে দেখেছি।

পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজ স্থাপনের পর জিকের কর্মীদের শিক্ষার দিগন্ত আরো বিস্তৃত হয়, কেউ কেউ গণ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও উচ্চ শিক্ষা লাভ করে দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হবার সুযোগ পান।

স্বাস্থ্যকর্মী রেজিয়া ছিলেন প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী তারিক ভাইয়ের সহকারী, যিনি জাফর ভাইয়ের সাথে সুইডেন থেকে “রাইট লাইভলিহুড এওয়ার্ড” আনতে গিয়েছিলেন ‘৯২ সালে। শুনেছি এটি “বিকল্প নোবেল পুরষ্কার”। লাইব্রেরিতে রেজিয়ার সেই পুরস্কার নেয়ার গৌরবময় ছবিটা বাঁধিয়ে রাখা ছিল। যাহোক, সেই রেজিয়া, হাওয়াকে বুঝিয়ে দিলেন আমাকে গ্রামে নিয়ে কি কি দেখাতে হবে।

সুইডেন থেকে জাফর ভাই তরুণ বয়সেই ১৯৭৪ সালে “যুব শান্তি পুরষ্কার” পেয়েছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও গ্রামের মানুষদের জন্য স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করার জন্য। উল্লেখ্য যে, জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ব্যতিক্রমী পরিবার পরিকল্পনা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসুচিতে অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ পুরষ্কার প্রথমবারের মতো ঘোষিত “স্বাধীনতা পুরষ্কার” গ্রহণ করেন। অন্যদিকে, এশিয়ার নোবেল প্রাইজ বলে খ্যাত ফিলিপাইনের “র‍্যামন ম্যাগসাইসাই পুরষ্কার” (১৯৮৫) ছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কমিউনিটিতে নেতৃত্ব আর বাংলাদেশের প্রথম ঔষধনীতি তৈরিতে অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

বাংলাদেশে ১৯৮২ সালের “জাতীয় ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ” (THE DRUGS (CONTROL) ORDINANCE, 1982) ঘোষণার ফলে ১,৭৪২ টি ক্ষতিকর, অপ্রয়োজনীয় ও অকেজো ঔষধ উৎপাদন, বিতরণ ও আমদানি নিষিদ্ধ হয়। এই উদ্যোগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল। এর ফলে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর ‘ব্রিফকেস কারখানা’ স্থাপনের সুযোগও বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে যে সব সহজ প্রযুক্তির ঔষধ দেশীয় কোম্পানীগুলোই তৈরি করতে পারে, সে সব ঔষধের আমদানিও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঔষধের দাম মানুষের হাতের নাগালে আসে এবং দেশীয় উদ্যোগের বিস্তার লাভ করে। কিন্তু এই যাত্রা অত সহজ ছিল না।

যাহোক, আবার গ্রামের পথে হাঁটা যাক। যেহেতু আমি সাথে যাচ্ছি, হাওয়া তার বাইসাইকেলটা রেখে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ ব্যাগটা নিয়ে আমাকে সহ বাসে করে বংশী নদীর ঘাটে এল। আগেই বলেছি, জিকের নারী স্বাস্থ্যকর্মীরা ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম বাইসাইকেল ব্যবহার করতে শুরু করে। হাওয়ার ব্যাগে ছিল রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, স্টেথোস্কোপ, জ্বর মাপার জন্য থার্মোমিটার, মাপার ফিতা, প্রস্রাবের এলবুমিন ও সুগার নিরূপণের কিট, নেইল কাতার, জিকের স্বাস্থ্যবীমা কার্ড আর কিছু প্রয়োজনীয় ঔষধ। যাহোক, নয়ারহাটের সেই ঘাট থেকে নৌকায় একটা কাছাকাছি গ্রামে গেলাম।

পাবলিক হেলথের প্রথম ছবক কি ছিল আমার মনে নাই, তবে এটুকু মনে আছে প্রথম বাড়িটিতে ঢুকতেই বাড়ির মহিলার সাথে তার যে আন্তরিকতার সম্পর্ক দেখলাম, তাতে তারা আত্মীয় কিনা ভুল ভাবতেই পারতাম। বাড়িতে ঢুকে হাওয়ার প্রথম কথা ছিল, ‘আপা কি পিঠা বানাইতেছেন নাকি?’ তারপরে নিরীহ গোয়েন্দার মত মিশে গিয়ে গত কয়েকদিনে এই পাড়ার জন্ম, মৃত্যু, অসুস্থতা, মাইগ্রেশনের তথ্য নেয়ার প্রয়াস।

গ্রামবাসীর সাথে কর্মীদের এই অনাবিল সম্পর্কই কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্য কর্মসুচির ভিত্তি গড়ে দিয়েছে বলে মনে হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ ছিল মূলত মা ও শিশুদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, পরামর্শ আর সীমিত কিছু ঔষধও দিতে পারত ওরা। এন্টিবায়োটিক দিতে হলে ‘ডাক্তার ভাই দেখবেন’ লিখে রেফার করত।

হাওয়ার কাছ থেকে প্রথম ছবক নিয়ে থাকলে দ্বিতীয় লেসনটা ছিল কাশেম ভাইয়ের। প্রথম সপ্তাহের বুধ-সন্ধ্যার নিয়মিত সেমিনারে ভোলার এক দ্বীপের টীকাদান নিয়ে কথা উঠেছিল। সেখানে কোল্ড চেইন রক্ষা করা অর্থাৎ নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বহন করে টীকাদান কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হত না, কেননা পথেই চলে যেত দীর্ঘ সময়।

কাশেম ভাই নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘টীকাদান কেন্দ্র চলছে তো?’
‘জ্বি ভাই চলছে’
‘ঠিক আছে, ওখানের লোকজন আগে সুই ফুটানোতে অভ্যস্ত হোক, কোল্ড চেইন যথাসময়ে হবে।‘

এই মন্তব্য থেকে আমার শিক্ষা ছিল দুটি:
এক. জীবন যেখানে যেমন;
দুই. মানুষের অভ্যাস আর কালচার পরিবর্তন করা যেহেতু কঠিন, দৃশ্যমান কোনো উন্নতি চোখে না পড়লেও অভ্যাসের মধ্যে ঢুকে যেতে পারাটাও এক বিশাল প্রাথমিক অর্জন।

সেদিন কেন্দ্রে ফেরার সাথে সাথেই দেখি নূরজাহান আপা হাওয়াকে ডেকে বলছেন তার গ্রাম থেকে রেফার করা গর্ভবতী এসেছে। হাওয়া ছুটে গেল সিকরুমে। অন্যদিকে রেজিয়া আপা তারিক ভাইয়ের রেফারেন্স দিয়ে আমাকে জানালেন পরদিন সন্ধ্যায় আমাকে ইতালিয়ানদের ক্লাস নিতে হবে। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! আমি যে ইতালীয় ভাষা জানি না! আসলে এই ‘ইতালিয়ান’রা হচ্ছে ইতালির আর্থিক সাহায্যে গড়া শ্রীপুরের প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ইন্টার্নশিপ করতে আসা শিক্ষানবিশ দল। এই ইন্টার্নশিপের পরেই তাদের কোর্স সমাপ্ত হবে। ইতালিয়ানদের পরবর্তী ব্যাচটিকে তিন মাস যাবত স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রাথমিক বিদ্যা শিখানোর ভার নিয়ে আমি অচিরেই শ্রীপুরে ডেপুটেশনে যাচ্ছি।

সন্ধ্যায় লাইব্রেরিতে বসে জ্বর, ম্যালেরিয়া আর টাইফয়েডের ক্লাস নেয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। তারিক ভাই দু’হাতে নানারকম বাংলা ইংরেজি ম্যানুয়েল সরবরাহ করতে থাকলেন। আমিও আনন্দ নিয়ে অনেক কিছুই অনুবাদ করতে থাকলাম। ক্লাস নিতে গিয়ে দেখি প্রশিক্ষণার্থী প্যারামেডিক ছাড়াও অন্যান্য প্যারামেডিকরাও উপস্থিত। দক্ষ প্রশিক্ষক মোসলেম ভাই পিছনের সারিতে বসেছিলেন। ক্লাস শেষে তিনিও দু একটি প্রশ্ন করেছিলেন।

সে সময় এই লাইব্রেরিতে শাহীন নামের একজন মহিলা লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। আমার জানা ছিল যে অকাল প্রয়াত কবি নাসিমা সুলতানা এক সময়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজ করতেন। আমি মনে মনে নাসিমা সুলতানাকে জিকের প্রাক্তন লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কল্পনা করে নিতাম। কবির কথা মনে পড়ে গেল যেহেতু আজ জিকের কথা এখানেই শেষ করে কবির কবিতা পড়া যাক –

যে পাতাগুলি ঝরেনি
যে ফুল ফোটেনি, এখনও রয়েছে, তাদের জন্য আমি যাবো না
আমি দেখবো না সে ফুলগুলো ফুটতে ফুটতে ভালোবাসার বেদনা
কেমন তিরতির করে কাঁপছে ভোরবেলাকার হিমে একটা স্মৃতি-বিক্ষত শীতকাল
কদাকার কালশিটে শহর, দোকানপাট
যে যায় যাক
(কবি নাসিমা সুলতানা)

এই লেখা লিখতে লিখতে শুনলাম কয়েক বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রেজিয়ারও অকাল প্রয়াণ হয়েছে। জাফর ভাই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে নানা রকম জটিলতার সাথে লড়ছেন জেনে অজানা আশংকায় মনটাও ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। ইতিহাসের মানুষগুলো চলে যাচ্ছেন।

লেখক – ডা. মোশতাক আহমদ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কবি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন।

(ধারাবাহিক চলবে…)

আরও খবর দেখুনঃ ইতিহাসের ডায়েরীকরোনা আপডেট

News Bd, News Bd, News Bd, News Bd

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × one =

Back to top button