অপরাধ ও দূর্ঘটনা

শুরু–শেষটা বেওয়ারিশ হিসেবে, মাঝে ২৭ বছরের জীবন!

মেয়ে শিশুটিকে দুই মাস বয়সে যখন বাড্ডার প্রধান সড়কের পাশে পাওয়া গিয়েছিলো তখন তার নাম-পরিচয় ছিলো না। এরপর কেটে গেছে প্রায় ২৭ বছর।

পরিবার, সন্তান, পরিচয় সবই হয়েছিলো তার। কিন্তু ঝোপের মধ্যে তার লাশটি যখন মিললো তখন সেই বেওয়ারিশই ছিলেন তিনি। অবশ্য কয়েকদিন পর পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে মেয়েটির পরিচয়, পরিবার এবং হত্যাকারীদের সন্ধান।

গত ১৯ জুন রাজধানীর তিনশ ফুট সড়কের পাশে লাশটি পাওয়া যায়। সাদা প্রিন্টের কামিজ আর লাল সালোয়ার পড়া লাশটি উপুড় হয়ে পড়েছিলো একটি ঝোপের মধ্যে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, ওই নারীর নাম সুমি (২৭)। পরিচয় বের করার পর ওই নারীর মেয়ের খাতায় “ইমার্জেন্সি” হিসেবে টুকে রাখা একটি মুঠোফোনের সূত্র ধরে সিআইডি শনাক্ত করেছে তিন হত্যাকারীকেও।

ঘটনাটি তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর নন্দিপাড়ার একটি বাড়িতে তিনদিন যৌন নিপীড়নের শিকার হন সুমি। এ সময় অসুস্থতার কথা বললেও তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি। ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে সিআইডি সুমির এমন একটি জীবনের সন্ধান পেয়েছেন যার শুরু এবং শেষ দুটোই হয়েছে বেওয়ারিশ হিসেবে। এর মধ্যকার সময়টুকুতে আছে বিয়ে, বিচ্ছেদ আর উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কিছু চিহ্ন।

সুমির বেড়ে ওঠা রাজধানীতে। এক নারীরা মাতৃস্নেহে তিনি বড় হয়েছেন, এই নারী সুমির পালক মা।

সুমির পালক মা বলেন, সুমিকে কোনো এক নারী অপরিচিত একটি ছোট ছেলের কোলে রেখে চলে যান। ছেলেটিকে তিনি বলেছিলেন মজার খাবার নিয়ে আসছেন। কিন্তু আর ফেরননি। তখন সুমির ২ মাস বয়স। ওই নারী জানালেন তাঁর নিজের কোনো সন্তান নেই। এলাকার লোকজন তখন তাকে শিশুটির লালন-পালনের দায়িত্ব দেন। শিশুটির কোনো নাম-পরিচয় তাদের জানা নেই। অসুস্থ হওয়ায় তাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে তার নাম দেওয়া হয়। তারা তাকে সুমি বলেই ডাকতেন। তিনি বলেন, নিজের মেয়ের মতই তিনি সুমিকে লালন-পালন করেছেন। সুমি চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সময় এলাকার ছেলেরা বিরক্ত করতে শুরু করেন। পড়ালেখা তখন বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সালে তাকে বিয়ে দেন এক যুবকের সঙ্গে। সে ঢাকাতেই প্রাইভেট কার চালাতেন। থাকতেন তাদের বাসার পাশেই। বয়সের ব্যবধান বেশি হওয়ায় ওই ছেলের সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছিলো না। ২০১৪ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। তবে এরই মধ্যে এক মেয়ে (৯ বছর) ও এক ছেলের (৭ বছর) জন্ম হয়। সন্তানদের নিয়ে সুমি আবার তাদের কাছে চলে আসেন।

সুমির পরবর্তী জীবন নিয়ে পালক বাবা–মায়ের আর তেমন কোনো ধারণ নেই। ছেলে-মেয়েকে তার কাছে রেখে সুমি আলাদা থাকা শুরু করেন। বুটিকের কাজ শুরু করেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। এক সময় নাকি শুটিং এর প্রস্তাবও পেয়েছিলেন। এটুকুই তারা জানেন। তবে সুমি হত্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা বিচ্ছেদ পরবর্তী জীবনের খোঁজ পেয়েছেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, সুমির লাশের পরিচয় নিয়ে তারা ধন্দে পড়ে যান। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ধরে খোঁজ নিয়ে পরিচয় মেলেনি। লাশ উদ্ধারের তিনদিনের মাথায় যেসব হোটেলে সুমি নাচতেন সেই বলয়ের একজন নিজ উদ্যোগেই সুমির নাম এবং তার সাবেক স্বামীর নাম ও গ্রামের ঠিকানা তাদের জানান। সাবেক স্বামী রাজধানীর ঝিগাতলায় নারীদের একটি হোস্টেলে দারোয়ানের কাজ করেন বলে জানতে পারেন। তাঁকে বের করলে তিনিউ তদন্তকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে যান সুমির পালক বাবা-মা ও সন্তানদের কাছে।

সিআইডির ঢাকা মেট্রো উত্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মামুন জাকির হোসাইন বলেন, সুমি কোথায় থাকেন, কি করেন সে বিষয়ে তার পালক বাবা-মা কিছুই জানতেন না। বিবাহ বিচ্ছেদ পরবর্তী সুমির জীবনের কারও সঙ্গে তাদের যোগাযোগও ছিলো না। তাই তারা কিছু বলতেও পারছিলেন না। তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া সুমির নয় বছরের মেয়েটি তার একটি খাতা নিয়ে আসে। সেখানে “ইমার্জেন্সি” নামে একটি মুঠোফোন নম্বর টুকে রাখা ছিলো।

মুঠোফোন নম্বরটি ধরে এর মালিককে খুঁজে বের করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। ওই ব্যক্তি জাহাঙ্গীররনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। তার নিজের পরিবারেও টানাপোড়ন চলছে। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে তিনি এবং সুমি এক সঙ্গে থাকতেন। তাদের পাশেই থাকেন আরেক নারী। এই নারীই সুমিকে হোটেলে নাচের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন। ওই নারী জানান, সুমি সর্বশেষ ফারুকুল ইসলাম নামে কমলাপুর রেলস্টেশনের এক জেনারেটর অপারেটরের কাছে গিয়েছিলেন। তিনিই ফারুকের বাসাটি চিনিয়ে দেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, নন্দীপাড়ায় ফারুকের বাবার দুতলা বাসা। নিচ তলায় ফারুকের বাবা-মা থাকেন। আর দোতলায় তার বন্ধু সালাউদ্দিন খলিফা ওরফে সুমন ও তার বন্ধু কাজী ইমরান মাহমুদ থাকেন। সালাউদ্দিন একটি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপকের চাকরী করেন। আর ইমরান মুঠোফোনভিত্তক রাইড শেয়ারিং এ মোটরসাইকেল চালান। এই তিনজনই সুমিকে তিনদিন আটকে রেখে জোরপূর্বক যৌন নির্যাতন করেন। ১৮ জুন তার মৃত্যু হলে পরদিন একটি সিএনজিতে করে তারা লাশ নিয়ে ৩০০ ফিট সড়কে ফেলে আসে। এই তিনজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মামুন জাকির হোসাইন বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে হোটেলগুলোতে নাচ-গান বন্ধ হয়ে গেছে। সুমিও তাই কয়েক মাস ধরে বেকার ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে নিজের এবং সন্তানদের খরচ যোগান দিতেই তিনি এই পথ বেছে নিয়েছিলেন বলে তারা মনে করছেন।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, সুমির পিত্তথলিতে পাথর হয়েছিলো। এজন্য তিনি প্রায়ই শারিরীক বিভিন্ন জটিলতায় ভুগতেন। গ্রেপ্তার তিনজনকে তিনি শরীর খারাপের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাকে নিস্তার দেয়নি।

সুত্রঃ প্রথম আলো

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 − 1 =

Back to top button