অপরাধ ও দূর্ঘটনা

প্রদীপের নিচে শুধুই অন্ধকার

সদ্য প্রত্যাহার হওয়া টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। যেন প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দফায় দফায় পার পেয়ে গেলেও এবার আর শেষরক্ষা হয়নি। সাতজন পুলিশ সদস্য গতকাল কক্সবাজার আদালতে হাজির হলে তাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে তিনজনকে সাত দিনের রিমান্ডের আদেশ দেয় আদালত।

মূলত মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকান্ডে প্রদীপের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসার পরই মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা। মাদক নির্মূলের অসিলায় ক্রসফায়ারের নামে কন্ট্রাক্ট কিলিং, লোকজনকে জিম্মি করে টাকা আদায়, এমনকি ধর্ষণে সহায়তার অভিযোগও উঠছে তার বিরুদ্ধে। প্রদীপের দানবীয় কর্মকান্ড থেকে রক্ষা পায়নি বোনের জায়গাও!

অভিযোগ উঠেছে, অনৈতিক কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে প্রদীপ আয় করেছেন শত শত কোটি টাকা। দেশ-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ থানা থেকে সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের চাকরিজীবনের পুরোটাই সমালোচনা ও বিতর্কে ভরা।

বিতর্কিত এই পুলিশ কর্মকর্তা নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে চাকরিজীবনে বরখাস্ত ও প্রত্যাহার হয়েছেন কমপক্ষে পাঁচবার। প্রতিবার অদৃশ্য ক্ষমতাবলে ফিরেছেন স্বপদে। পদে ফিরেই ধারণ করেছেন দানবীয় রূপ। প্রভাবশালী প্রদীপের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাও।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, প্রদীপ কুমার দাশ তিন বছর ধরে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। তার কাছে সবাই অসহায় ছিল। একাধিক সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের এক শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ ওঠে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটি ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় তিনি বরখাস্ত হন। তবে তাকে বহাল করার জন্য দেশের অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি ফোন করেছেন পুলিশের নীতিনির্ধারকদের কাছে।

অল্প দিনের মধ্যেই প্রদীপ চাকরি ফিরে পেয়ে পুনরায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তবে এর আগে ২০১৩ সালে একটি মামলার বিরোধিতা করায় এক আইনজীবীকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে পাঁচলাইশ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে।

এ ঘটনায় প্রদীপসহ আট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন ওই আইনজীবী। একই বছরের ২৪ মে পাঁচলাইশ থানার পাশের একটি কমিউনিটি সেন্টার থেকে শিবির আখ্যা দিয়ে ৪০ ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকে আটক করেন প্রদীপ। ওই সময় তিনি ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিতও হন। পাঁচলাইশে ওসি থাকাকালে বাদুড়তলায় বোরকা পরা এক বৃদ্ধাকে রাজপথে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে ব্যাপক সমালোচিত হন প্রদীপ। এ ঘটনার পর সারা দেশে তোলপাড় হয়।

এরপর পাঁচলাইশ থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয় ওসি প্রদীপকে। ২০১২ সালে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) পতেঙ্গা থানার ওসির দায়িত্ব পালনকালে আদালতের অনুমতি ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজকে তেল সরবরাহে বাধা দেওয়া, বার্জ আটক এবং বার্জ মালিকসহ ১২ ব্যক্তিকে মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এসব ঘটনা ফাঁস হলে প্রশাসনে ব্যাপক তোলপাড় হয়।

পুলিশ সদর দফতর গঠিত তদন্ত কমিটি প্রদীপকে অভিযুক্ত করলে পতেঙ্গা থানা থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। সিএমপির কোতোয়ালির উপপরিদর্শক (এসআই) থাকাকালে নগরের পাথরঘাটার এক হিন্দু বিধবা মহিলার জমি দখলের অভিযোগ ওঠে প্রদীপের বিরুদ্ধে। একই সময়ে প্রদীপ কুমারের রোষানল থেকে রেহাই পাননি তার নিজের পরিবারের সদস্যও। নগরের পাঁচলাইশ থানা এলাকায় এক বোনের জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কাউকে পাত্তাই দিতেন না প্রদীপ।

গত তিন বছরে মাদকবিরোধী অভিযানে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে চলতি মাস পর্যন্ত ১৪৪টি বন্দুকযুদ্ধে ২০৪ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু প্রদীপের নেতৃত্বেই দেড় শ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আকতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘প্রদীপ কুমার দাশ চাকরিজীবনের প্রায় পুরোটা সময় কাটিয়েছেন চট্টগ্রামে। মানুষকে হয়রানি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। আমাদের দাবি থাকবে, প্রদীপের অবৈধ আয়ের তদন্ত যেন দুদক ও এনবিআর করে।’ ১৩ জুলাই চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থকে টেকনাফে নিয়ে যাওয়া হয় ফারুক ও আজাদ নামে দুই ভাইকে। তাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার তিন দিনের মাথায় দুই ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত দুই যুবকের বোন আইরিন আকতার বলেন, ‘আমার দুই ভাইকে ধরে নিয়ে ওসি প্রদীপ ৮ লাখ টাকা দাবি করেন। তার চাহিদামতো টাকা না দেওয়ায় ক্রসফায়ারে ভাইদের হত্যা করা হয়। আমি আমার দুই ভাই হত্যার বিচার চাই।’

সূত্র বলছেন, নব্বইয়ের দশকে বিএনপি সরকার আমলে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর সুপারিশে পুলিশে যোগদান করেন প্রদীপ কুমার দাশ। এসআই হিসেবে পুলিশে যোগদানের পর থেকে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে একের পর এক ঘটনার জন্ম দেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভোল পাল্টে প্রদীপ অনেক প্রভাবশালীর কাছের লোক হয়ে ওঠেন। ২০১৭ সালে মহেশখালী থানায় ওসি হিসেবে যোগ দিয়ে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণের নামে নিত্যনতুন কৌশলে অপকর্ম করতে থাকেন তিনি। দুই বছর আগে টেকনাফ থানায় যোগদানের পর আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন প্রদীপ। ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে নিয়মিতভাবে টাকা আদায়, লুটপাট, মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাতসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয় অনেক দালালের মধ্যে অন্যতম হলো হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের দফাদার আমিনুল ইসলাম। তার মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ীসহ স্থানীয় বিত্তশালীদের টার্গেট করতেন প্রদীপ।

ক্রসফায়ার ও মামলার ভয় দেখিয়ে ধনাঢ্য পরিবারগুলোর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ঝিমংখালীর ৭০ বছরের এক প্রাথমিক শিক্ষকের কাছ থেকে তিনি ৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। হোয়াইক্যংয়ের আনোয়ার নামে এক ব্যক্তিকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে প্রদীপের বিরুদ্ধে। এর প্রতিকার চাইতে তার স্ত্রী ও বোন আদালতে গেলে তাদের উঠিয়ে নিয়ে পাঁচ দিন আটকে রাখার বিষয়টিও এলাকায় সবার মুখে মুখে। তবে প্রদীপের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি।

ওসি প্রদীপসহ তিনজনের সাত দিনের রিমান্ড : মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলায় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের তত্ত্বাবধানে পরিদর্শক প্রদীপ কক্সবাজার আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। গতকাল বিকাল ৫টার দিকে আদালতে ওঠার আগেই পরিদর্শক লিয়াকত আলী, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতসহ সাত পুলিশ সদস্য কঠোর নিরাপত্তায় ৪টার দিকে আদালতে যান। এর মধ্যে ওসি প্রদীপ অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে আগেভাগে ছুটি নিয়ে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন।

মেজর সিনহা হত্যার আসামিদের আনার খবরে অসংখ্য মানুষ ভিড় করে আদালত এলাকায়। বিভিন্ন সংস্থার সদস্যের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রথমে আদালত আত্মসমর্পণকারীদের গ্রেফতার দেখিয়ে জেল হাজতে পাঠানোর আদেশ দেয়। তবে রাত ৮টার দিকে র‌্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা আসামি প্রত্যেকের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের প্রত্যাহৃত পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দলাল রক্ষিতের প্রত্যেককে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।

বাকি চার আসামিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন কক্সবাজার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের (আদালত নম্বর-৩, টেকনাফ) বিচারক মুহা. হেলাল উদ্দিন। বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, করোনাকালীন হাই কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথম দফায় চারজন ও দ্বিতীয় দফায় তিনজন আসামিকে হাজতখানা থেকে কাঠগড়ায় আনা হয়। মামলার বাকি দুই আসামি আত্মসমর্পণ করেননি।

তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেছেন, মামলায় উল্লিখিত ৮ নম্বর আসামি এসআই টুটুল ও ৯ নম্বর আসামি কনস্টেবল মো. মোস্তফা নামে কোনো পুলিশ সদস্য জেলা পুলিশে নেই। সুত্র বিডি প্রতিদিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × four =

Back to top button