গুমের সঙ্গে অন্য দেশ জড়িত কি-না তদন্তের দাবি
গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাইরের কোনো দেশ জড়িত কি না তা তদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মানুষের অধিকার হরণ করে তাদের ভয় দেখানোর জন্য গুমকে সরকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। রোববার এক ভার্চুয়াল আলোচনায় এ কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব।
আন্তজার্তিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে এই ভার্চুয়াল আলোচনার আয়োজন করে বিএনপি। আলোচনায় অংশ নেন বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ অতীতে গুম খুনের শিকার পরিবারের সদস্যরা।
সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডে সবাই সরব হলেও দলীয় নেতাদের গুমের সময় সব মহলের নীরবতার সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব। বলেন, ইলিয়াস আলীসহ অনেকের গুম হওয়া ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বাইরের কোনো দেশ এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত কিনা। এবং বাইরের কোনো দেশ আমাদের দেশের কোনো নাগরিককে সে যে দলেরই হোক তাদেরকে যেভাবে খবরগুলো এসেছে, সেই খবরগুলো যদি সত্যি হয় তাদেরকে তুলে নিয়ে যায়, অত্যন্ত ভয়াবহ চিত্র। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সবই বিপন্নের মুখে। এটারও ইনকোয়ারি করা উচিত। এটার ভালোভাবে ইনভেস্টিগেশন হওয়া উচিত।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, গুমের শিকার পরিবারগুলোর ভোগান্তি হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারের চেয়েও ভয়াবহ। গুম হওয়া ব্যক্তিদের দ্রুত পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ারও দাবি জানান তিনি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বাংলাদেশে এই এনফোর্স ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সের বিষয়টি একেবারেই নতুন নয়। এটা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যেও যেভাবে হত্যা হয়েছিল এই আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর ২০০৯ সাল থেকে তারা আবার এই অস্ত্রটাকে বেছে নিয়েছে। আজকে ডেইলি স্টারের একদম প্রথম পেজে দেখুন একটি মর্মান্তিক করুণ দৃশ্য। এই দৃশ্য আমরা গত ১০ বছর ধরে দেখছি যে সন্তানরা কাঁদছে, তারা আত্মচিৎকার করে বলছে, আমি আমার বাবার সঙ্গে ঈদ করতে চাই। আমি আমার বাবাকে দেখতে চাই।’
অনুষ্ঠানে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের আমলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা তুলে ধরেন তাদের দুর্বিসহ জীবনের চিত্র।
বাংলাদেশে গুম ও বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, আজকে প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা, আজকে এক লক্ষের ওপরে মামলা এবং মারা গেছেন ২ হাজার ৬০০ শর উপরে, আর ৬০৩-এর উপরে গুম হয়ে গেছে, ৮৪২ জন মারা গেছেন। এই সব তথ্য ডুকেমেন্টেড, যারা রিপোর্ট করেছেন তাদের, আনডুকেমেন্টেড অনেক আছে। এটা সম্পূর্ণ তথ্য নয়, অনেক তথ্য আছে যেটা আমাদের কাছে নেই।
‘আমরা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আমরা এসব ঘটনা নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। এজন্য তাদের বাংলাদেশে গুম ও বিচারবর্হিভৃত হত্যা ঘটনাবলীর তদন্তে একটি জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করা উচিত।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ২০০৯ সাল থেকে গুম হওয়ার ঘটনাসমূহ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে সংবাদ ব্রিফিং এবং এর খসড়া জাতিসংঘের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই ঘটনাগুলো সম্পর্কে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সংবাদ সম্মেলন করে ব্রিফিং করেছি। আমাদের দলীয় প্রধান এর খসড়া জাতিসংঘকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক কোনো অ্যাকশন এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা আজকে এক কঠিন সময় পার করছি। এই সময় আমাদেরকে রক্ষা করার সময়, এই সময় আমাদের গণতন্ত্রকে রক্ষা করার সময়, এই সময় আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার সময়, আমাদের রক্তের বিনিময় স্বাধীনতাকে রক্ষা করার সময়। বাংলাদেশ এখন সম্পূর্ণভাবে একটি গণতন্ত্রহীন, ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র একটা দেশে পরিণত হয়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আসুন আমরা সেই লক্ষ্যে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে। নিজেদের মধ্যে ছোট-খাটো বিভেদ ভুলে দিয়ে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই।
সাবেক এ প্রতিমন্ত্রী বলেন, এদেশের মানুষ আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে দেখে। এখনো হাজার হাজার মহিলা তাঁর মুক্তির জন্যে, তাঁর সুস্বাস্থ্যের জন্য রোজা রাখে, দোয়া করে। আমরা দৃঢ় বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের মানুষ উঠে দাঁড়াবে, তারা তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতাকে ফিরিয়ে আনবে, হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনবে, হারিয়ে যাওয়া অধিকারগুলোকে তারা ফিরিয়ে আনবে।
ভার্চুয়াল ওয়েবিনারে বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান বাংলাদেশ মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম ও বিচারবর্হিভুত হত্যা ও নিপীড়ন-নির্যাতন সম্বলিত মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামা ওবায়েদের সঞ্চালনায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, আবদুল মঈন খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহিদুজ্জামান, ১৯৭৪ সালে গুম হওয়া ন্যাপ নেতা আবু বকর জাফর উদ-দৌলা দিপুর বোন ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য তরিকুল ইসলামের স্ত্রী অধ্যাপক নার্গিস বেগম, ২০১৭ সালে গুম বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক সাংসদ এম ইলিয়াস আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আবরার ইলিয়াস, ২০১৩ সালে গুম হওয়া ঢাকার ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম ও গুম হওয়া লাকসাম পৌরসভার সভাপতি পারভেজ কবির হীরুর স্ত্রী শাহনাজ আখতার বক্তব্য দেন।
এই ভার্চুয়াল ওয়েবনিয়ারে ঢাকাস্থ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিসহ বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, তাবিথ আউয়াল, জেবা আহমেদ, মীর হেলাল, ফারজানা শারমিন, জাহিদুল আলম হিটো, জুয়েল মন্ডল, ইয়াসীর খান চৌধুরী প্রমুখ যুক্ত ছিলেন।