চলচিত্র শিল্পে সুদিনের আশা, দর্শক ফিরছে এশিয়ার প্রেক্ষাগৃহে
বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর প্রভাবশালী বিনোদন শিল্প যুক্তরাষ্ট্রের হলিউড। কিন্তু, মহামারীতে দেশটির প্রেক্ষাগৃহ শিল্পে দেখা দিয়েছে শনির দশা।
প্রশ্ন করা যেতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাগৃহের আলো কী চিরতরে নিভিয়ে দিয়েছে চলমান মহামারী? নাকি ঘরে থাকার নির্দেশ, প্রেক্ষাগৃহে নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতার নির্দেশনা এবং জীবাণু সংক্রমণের প্রচলিত ভয় থেকেই- একবছরের বেশি সময় হলো দর্শকের ভিড় দেখা যাচ্ছে না? হয়তো সেকারণেই, বহুল প্রত্যাশিত বেশকিছু ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্র দেরিতে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্টুডিওগুলো। সবমিলিয়ে গতবছর উত্তর আমেরিকা মহাদেশে ১৯৮১ সালের পর বক্স অফিস সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে নেমে আসে। ব্যবসার অভাবে এখন দেউলিয়াত্ব এড়াতে লড়ছে প্রেক্ষাগৃহ শিল্প। সঙ্গে এ আশাও করছে, সঙ্কট কাটার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়মিত গ্রাহক ও বড় পর্দার ভক্তরাও ফিরবেন।
সে আশায় আগামী দিন কী যোগ করে, তা হয়তো অচিরেই দেখা যাবে। কিন্তু, এশিয়ায় দেখা যাচ্ছে বিপরীত দৃশ্য। মহামারীর শুরুর দিকে এ অঞ্চলের সিংহভাগ চলচ্চিত্র প্রদর্শন ব্যবসা মার খেলেও, এখন দর্শকেরা ফের থিয়েটারমুখী হচ্ছেন। এমনকি বক্স অফিস দেখছে রেকর্ড প্রবৃদ্ধির আশাজনক জোয়ার।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি চীনের কথাই বলা যাক প্রথমে। সরকারি দাবি অনুসারে, দেশটিতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ এখন পুরোটাই নিয়ন্ত্রণে। তাই চলতি জানুয়ারির প্রথম ১০ দিনে গত বছরের একইসময়ের তুলনায় দর্শক বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। জাপানের বৃহৎ প্রেক্ষাগৃহ সংস্থা আইম্যাক্স কর্পও সপ্তাহান্তের ছুটির দিনে রেকর্ড দর্শক সংখ্যার কথা জানায়। তাইওয়ান থেকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশসমূহের প্রায় সবকটিতেই বাড়ছে থিয়েটারগামী দর্শক স্রোত।
অপ্রত্যাশিত সাফল্যের গল্প থেকে কী যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা নিতে পারে?
বাস্তবতা হলো; মহামারীর আগে থেকেই এক ধরনের মন্দায় পড়েছিল মার্কিন প্রেক্ষাগৃহ শিল্প। স্ট্রিমিং সেবাগুলোর দিন দিন জনপ্রিয়তা এবং গেমিং এর মতো অন্যান্য প্রকার বিনোদন উপকরণের সুবাদে; প্রেক্ষাগৃহ শিল্প মুষ্টিমেয় কিছু ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। যেমন; ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে থিয়েটারের টিকেট বিক্রি ৪.৪ শতাংশ কমে ১১.৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ২০১৪ সালের পর যা ছিল সবচেয়ে বড় পতনের ঘটনা।
তারপরও, আশায় বুক বাঁধার মতো কিছু সম্ভাবনা ছিল। যেমন; গেল বছরের পহেলা মার্চ নাগাদ মার্কিন বক্স অফিস ১৬০ কোটি ডলার আয় করে, এটা ছিল ২০১৯ সালের একইসময়ের তুলনায় ৭.৩ শতাংশ বেশি। বহুল প্রতীক্ষিত একাধিক ব্লকবাস্টার ফিল্মের মুক্তি পাওয়াই ছিল যার প্রধান কারণ। ওই সময়ে মুক্তি পাওয়া এমন কিছু চলচ্চিত্র হলো; জেমস বন্ড সিরিজের নতুন ফিল্ম এবং ‘ডুন’ এর রিমেক। বছরের বাকি সময়টাও ব্যবসায় ছিল ঊর্দ্ধগতি। তারপরেই, দেখা দিল মহামারী। স্টুডিওগুলো নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে বড় বাজেটের চলচ্চিত্র মুক্তি পেছানোর ঘোষণা দিতে থাকে। যেমন পিছিয়ে যায় বন্ডের নতুন সিনেমা।
ফলে মধ্য মার্চ নাগাদ অন্ধকার নেমে আসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহের পর্দায়। অনিশ্চিত অবস্থায় কবে খুলে দেওয়া হবে, সেটাও নিয়মিত দর্শকদের জানানো যায়নি। এপ্রিলে ইউনিভার্সাল পিকচার্স ঘোষণা দেয়, তারা ” স্ট্রোলস ওয়ার্ল্ড ট্যুর” বড় বাজেটের ফিল্মটি স্ট্রিমিং মাধ্যমে মুক্তি দেবে। খুব শিগগির অন্য স্টুডিওগুলোও তা অনুসরণ করে।
বলা চলে, এটাই ছিল যেন সেই মারণ আঘাত। একে দর্শক ঘরে স্বেচ্ছায় বন্দি, অন্যদিকে স্ট্রিমিং সেবার গ্রাহক সংখ্যা সবমিলিয়ে ৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধিতে প্রেক্ষাগৃহ শিল্পের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হয়। প্রতিক্রিয়ায় চলচ্চিত্র শিল্প এবং ভক্তরা জানান, ভিড়ে ভর্তি থিয়েটার আর টিকেটের বাড়তি মূল্য দিয়ে আর হয়তো কোনোদিন দর্শকেরা প্রেক্ষাগৃহমুখী হবেন না।
কিন্তু, এশিয়ার বর্তমান চিত্র বলছে আগাম মুষড়ে পড়ার কিছু নেই, সময় এখনও আছে। কোভিডের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মতো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় থিয়েটার বন্ধ হয়। ওই সময়ে নানা দেশের বিনোদন জগতে সেগুলো আর চালু করা সম্ভব হবে না এমনতর নেতিবাচক ধারণা জন্ম নেয়। কিন্তু, তারপর ভাইরাসে প্রতিরোধে নেওয়া কিছু সঠিক পদক্ষেপের কল্যাণে কমে আসতে থাকে সংক্রমণ গতি। ব্যাপকহারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পর্যাপ্ত জীবাণু প্রতিরোধী সুরক্ষা সরঞ্জাম, উৎস শনাক্তকরণ, শুরুর দিকেই জারি করা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং কঠোর কোয়ারেন্টিনের মতো পদক্ষেপের সুফল পায় এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান অর্থনীতিগুলো। মাস্কের ব্যবহার নিয়েও এশীয়রা মার্কিন নাগরিকদের মতো তাচ্ছিল্য করেননি বা তাদের সরকার সেটা করার সুযোগও দেয়নি। সকল ধরনের সেবামূলক ব্যবসায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতেও ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারি বজায় রাখে জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
তবে সবচেয়ে বড় সফলতা হয়তো ছিল স্থানীয় চলচ্চিত্র মুক্তির সংখ্যাবৃদ্ধি। হলিউডের জাঁকজমকের অনুপস্থিতিতে রাজত্ব বাড়ে এশীয় ফিল্মের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধের গল্পভিত্তিক চীনের “দ্য এইট হান্ড্রেড” তার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। চলচ্চিত্রটি বক্স অফিসে ৪৬ কোটি ডলার আয় করে গড় আয়ে বিশ্ব সেরার স্থান দখল করে। জাপানের “ডেমোন স্লেয়ার” ৩৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার আয় নিয়ে বৈশ্বিক তালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করে। আঞ্চলিক চলচিত্রের আরেক সুপারহিট সংযোজন দ. কোরিয় জম্বি মুভি “পেনিনসুলা”। সবমিলিয়ে ২০১৯ সালের ৪১ শতাংশের তুলনায় গেল বছরের শেষভাবে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিশ্বের মোট প্রেক্ষাগৃহ টিকেটের ৫১ শতাংশ বিক্রি হয়। ২০২০ এর শেষভাগে শুধু চিনেই ৩শ কোটি ডলারের টিকিট বিক্রি হয়। ফলে প্রথমবারের মতো প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসায় যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যায় দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসার জন্যে আসলে এগুলো শুভ সংবাদ। টিকাদান শুরু হওয়ায় আবারও মার্কিনীরা জন-সমাগম স্থলে নির্ভয়ে যাচ্ছেন। আর হলিউডও জমিয়ে রেখেছে নজিরবিহীন পরিমাণ বড় বাজেটের ফিল্ম। গ্রাহকেরা হলমুখী হলেই তারা সময়-সুযোগ বুঝে তাদের আরও কাছে টানতে আর গাঁটের টাকা আকর্ষণ করতে মুভিগুলো মুক্তি দেবে। এটাও সত্য যে নেটফ্লিক্স, হুলু বা অ্যামাজনের মতো স্ট্রিমিং সেবার সব গ্রাহক সোফায় আরাম করে কন্টেন্ট উপভোগ ছেড়ে থিয়েটারগামী হবেন না। কিন্তু, জাপান ও চীনের মতো দেশে ঘরে বন্দি মানুষের দীর্ঘদিন পর প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে চলচ্চিত্র উপভোগের সংখ্যা ইতিবাচক ইঙ্গিতই দেয়। মানুষ গৃহকোন থেকে মুক্তিও চায়। প্রেক্ষাগৃহ দেয় আপনজনদের নিয়ে নির্মল বিনোদনের সেই সুযোগ। যুক্তরাষ্ট্রে তা এখন জমা আছে বটে, কিন্তু দর্শকদের ভীতি দূর হলে অচিরেই তারা দলবেঁধে ফিরবেন, এমন সম্ভাবনাও জোরতালেই উঁকি দিচ্ছে।
মোদ্দা কথা, বড় পর্দার আকর্ষণই মূল, সেটা সহজে এড়ানোও যায় না।
সূত্রঃ টিবিএস